বিডিআর হত্যাকাণ্ড তদন্ত প্রতিবেদনে নাম, কী হবে আইজিপির?

বিডিআর হত্যাকাণ্ড তদন্তে জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার জন্য বর্তমান পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলমসহ পাঁচ পুলিশ কর্মকর্তার নাম এসেছে। স্পর্শকাতর ওই প্রতিবেদনে আইজিপির নাম আসার পরই প্রশাসনের ভেতরে নানা আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে।

প্রতিবেদনে আইজিপির বিরুদ্ধে নেতিবাচক তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। বিশেষ করে পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) দায়িত্ব পালনকালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখা এবং বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সক্রিয় থাকার অভিযোগ উঠে এসেছে বাহারুল আলমের বিরুদ্ধে। এ অবস্থায় তার ভাগ্যে কী হতে পারে-তা নিয়েও চলছে জল্পনা-কল্পনা।

বাহারুল আলমকে কোনো দেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেওয়া অথবা তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল-এ দুই সিদ্ধান্তের যেকোনো একটি হতে পারে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের নামে সীমান্তরক্ষী এই বাহিনীর তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়। সেই ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরণ আইনের মামলায় ১৩৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন আদালত। আরও অন্তত ২২৮ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। তবে ঘটনার তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে শুরু থেকেই নানা প্রশ্ন তুলে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে আসছিলেন ভুক্তভোগীরা।

ঘটনার দেড় দশক এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর সাত সদস্যের জাতীয় স্বাধীন কমিশন গঠন করে সরকার। তদন্ত কমিশন গত ৩০ নভেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।

সেই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ভয়ানক সব তথ্য। এতে বলা হয়েছে, বিডিআর হত্যাকাণ্ডে বহিঃশক্তির সরাসরি সম্পৃক্ততা ও তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সরাসরি জড়িত থাকার শক্তিশালী প্রমাণ মিলেছে। বিডিআর হত্যাকাণ্ড পরিকল্পিত এবং এর পেছনে প্রধান সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সাবেক মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস।

প্রতিবেদনে ১৪৬ নম্বর পয়েন্টে পাঁচজন পুলিশ কর্মকর্তার নাম রয়েছে। তারা হলেন, তৎকালীন আইজিপি নূর মোহাম্মদ, তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার নাইম আহমেদ, তৎকালীন অতিরিক্ত আইজিপি (এসবি প্রধান) বাহারুল আলম, সাবেক (পলাতক) অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলাম, বিডিআর হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা অতিরিক্ত ডিআইজি আব্দুল কাহার আকন্দ এবং তার অধীনস্থ তদন্ত দল।

বিডিআর হত্যাকাণ্ডের সময় পুলিশের বিশেষ শাখার নেতৃত্বে থাকা বাহারুল আলম বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের ১৯৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তা। হত্যাকাণ্ডের পরপরই তাকে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে পাঠানো হয়। ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি জাতিসংঘ সদর দপ্তরের শান্তিরক্ষা বিভাগে পুলিশের লিয়াজোঁ অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৫ সালে আফগানিস্তানে জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনের সিনিয়র পুলিশ অ্যাডভাইজার হিসেবেও কাজ করেন। ক্রোয়েশিয়া, সার্বিয়া, কসোভো ও সিয়েরা লিওনেও দায়িত্ব পালন করেন বাহারুল আলম। ২০২০ সালে অবসরে যান তিনি। ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ২০ নভেম্বর পুলিশ বাহিনীতে রদবদলের অংশ হিসেবে বাহারুল আলমকে চুক্তিভিত্তিক চাকরিতে ফিরিয়ে আইজিপির দায়িত্ব দেয় অন্তর্বর্তী সরকার।

তদন্ত কমিশন প্রধানের বক্তব্য

এ বিষয়ে জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রধান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমান বলেন, তদন্তে পাঁচজন পুলিশ কর্মকর্তার নাম এসেছে। তাদের মধ্যে বর্তমান আইজিপি বাহারুল আলমও আছেন।

কেন তাদের নাম এসেছে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার কারণেই তাদের নাম প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

আইজিপি যা বললেন

তদন্ত প্রতিবেদনে নাম আসার ব্যাপারে আইজিপি বাহারুল আলম গণমাধ্যমকে বলেন, তদন্ত কমিশন তদন্ত করেছে, এখন সরকার যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার নেবে। এখানে আমার দেখার বা বলার কিছু নেই।

‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় খুব সিরিয়াসলি দেখছে’

বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পর গঠিত একটি তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন এখনকার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।

মঙ্গলবার (২ ডিসেম্বর) সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কোর কমিটির সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) হত্যাকাণ্ড নিয়ে গঠন করা তদন্ত কমিশনের সুপারিশগুলো অবশ্যই বাস্তবায়ন করা হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এটা খুব সিরিয়াসলি দেখছে। অনেক ভলিউম, সবটা পড়া হয়নি। পড়া হলে উনাদের রেকোমেন্ডেশনগুলো অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে। ভালো ভালো রেকোমেন্ডেশন আছে। যেহেতু পুরোটা পড়িনি, সেহেতু এখন পুরোপুরি বলতে পারবো না।’

শহীদ পরিবারদের সংবাদ সম্মেলন ও দাবি

এদিকে, সোমবার (১ ডিসেম্বর) রাজধানীর মহাখালীর রাওয়া ক্লাবে ‘বিডিআর তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশে শহীদ পরিবারের মতপ্রকাশ’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে বিডিআর হত্যাকাণ্ডে শহীদ লেফটেন্যান্ট কর্নেল লুৎফর রহমানের মেয়ে ডা. ফাবলিহা বুশরা বলেন, ‘প্রতিবেদন অনুযায়ী অপরাধী হিসেবে যাদের নাম উঠে আসছে তা দেখার পরেই শুধু কমেন্ট করতে পারবো। এর আগে কোনো কমেন্ট করতে চাই না। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকুক এটাই আমরা চাই। সবার নিরাপত্তা চাই।’

তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে বুশরা বলেন, ‘আমাদের পূর্ণ আস্থা রয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে সত্য জানতে পারবো। যত দ্রুত সম্ভব তদন্ত প্রতিবেদন যেন জনসম্মুখে প্রকাশিত হয়। কারণ বিডিআর হত্যাকাণ্ডের কারণ সম্পর্কে জানার অধিকার দেশের সব নাগরিকের রয়েছে।’

সাবেক বিডিআরের (বর্তমান বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের ছেলে রাকিন আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, ‘এ হত্যাকাণ্ডের বিচার হতেই হবে, আমরা ছাড়বো না। রিপোর্টে যাদের নাম এসেছে তাদের বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করতে হবে সরকারকে। মীরজাফরদের বিচার করতে হবে, না হলে আরও একটা পিলখানা হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে।’

শহীদ সেনা পরিবারের অন্য সদস্যরা বলেন, পিলখানায় বিডিআর হত্যাকাণ্ডে জড়িত কেউ যেন বিচার থেকে রেহাই না পায়, সে বিষয়ে সরকারের কঠোর ভূমিকা রাখতে হবে। নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কা উল্লেখ করে শহীদ পরিবারগুলো নিরাপত্তা নিশ্চিতেরও দাবি জানিয়েছেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *