মাসুদ কামাল (Masud Kamal), বিশিষ্ট সাংবাদিক, স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন—জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নিজেদের এতদিন একটি মধ্যপন্থী, সংস্কারমুখী এবং নতুন ধারার দল হিসেবে তুলে ধরলেও, এখন জামা’তের সঙ্গে নির্বাচনী জোট গঠনের মধ্য দিয়ে তারা তাদের প্রকৃত আদর্শের প্রকাশ ঘটিয়েছে। তার মতে, “এতদিন এনসিপি যা বলেছে, সবই ছিল এক ধরনের ধোঁকা। দলটি নতুন রাজনীতির কথা বলে আসলেও, তারা শেষমেশ মানুষকে হতাশ করেছে।”
রবিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে (National Press Club) আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জামা’তের আমির শফিকুর রহমান জানিয়ে দেন, আগের আট দলীয় জোটে এখন এনসিপি এবং এলডিপি যুক্ত হয়ে ১০ দলীয় জোটে পরিণত হয়েছে। এই জোটে এনসিপিকে ৩০টি আসন দেওয়া হবে, যেখানে জামা’ত বা অন্য কেউ প্রার্থী দেবে না। বাকি ২৭০টি আসনে এনসিপির প্রার্থী থাকবে না, বরং তারা জোটের পক্ষে কাজ করবে।
জোটের সিদ্ধান্ত, কিন্তু পার্টি ভাঙনের সূচনা
জোট গঠনের পরই এনসিপির মধ্যে ভাঙনের সুর শোনা যাচ্ছে। দলটির বহু শীর্ষস্থানীয় নেতা পদত্যাগ করেছেন। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, নারী নেতৃত্বের একাধিক মুখপাত্র, যেমন—ডা. তাসনিম জারা, তাজদুবা জাবিন, এবং সামান্তা সারমিন—দল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
ডা. তাসনিম জারা বলেছেন, তিনি এনসিপির প্রার্থী থাকলেও এখন আর দলের সঙ্গে থাকছেন না এবং স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নেবেন। অন্যদিকে, তাজদুবা জাবিন নির্বাচন করবেন না, তবে তিনি একটি বিস্তৃত পোস্টে দলের ভেতরের সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়া ও আদর্শিক বিচ্যুতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
এছাড়া, মীর আশাদুল হক এবং সামান্তা সারমিনও দল থেকে সরে গেছেন বা কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। সামান্তা বলেন, “যদি এনসিপি জামা’তের সঙ্গে জোট করে, তবে তাদের চড়া মূল্য দিতে হবে।” তিনি জোর দিয়ে বলেন, এনসিপি যে বিচার সংস্কার, গণপরিষদ নির্বাচন এবং দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের যে ধারণা নিয়ে গঠিত হয়েছিল, জামা’তের রাজনীতির সঙ্গে তার কোনো মিল নেই।
ভোটাভুটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ, কিন্তু বিভক্ত মনোভাব
এনসিপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দলীয় কেন্দ্রীয় কমিটির ২১৪ জন সদস্যের মধ্যে ১৮৪ জন জামা’তের সঙ্গে নির্বাচনী জোটের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। যদিও এই সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, মাসুদ কামালের প্রশ্ন—”এতে কি প্রমাণ হয় না যে এনসিপির রাজনীতি আদতে এমনই ছিল?” তিনি বলেন, এতদিন তারা মধ্যপন্থার কথা বললেও, সেটি নাটক ছিল বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার জটিলতা ও সময়ের সংকট
এত বড় সিদ্ধান্ত দল তড়িঘড়ি করে নিয়েছে এমন এক সময়ে, যখন মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় হাতে মাত্র একদিন। মাসুদ কামাল বলছেন, “এটা ইচ্ছাকৃত সিদ্ধান্ত হতে পারে, যেন কেউ আর স্বতন্ত্রভাবে দাঁড়াতে না পারে।” বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী, স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে হলে ভোটারের ১% স্বাক্ষরসহ ফর্ম জমা দিতে হয়, যা একদিনে করা অত্যন্ত কঠিন।
তাসনিম জারা অবশ্য দ্রুত পদত্যাগ করে স্বাক্ষর সংগ্রহ শুরু করেছেন এবং ইতিমধ্যে অর্ধেকের বেশি কাজ শেষ বলেও জানা গেছে।
রাজনীতিহীন স্বার্থের রাজনীতি
মাসুদ কামাল কটাক্ষ করে বলেন, “এনসিপি আদতে একটি রাজনীতিহীন দল। তারা ক্ষমতা ও সুবিধা পেতে চেয়েছে শর্টকাট পথে।” তিনি বলেন, আন্দোলনের পর সরকারের কাছ থেকে তারা সুবিধা নিয়েছে, কেউ উপদেষ্টা হয়েছে, কেউ প্রভাব বিস্তার করেছে, কেউ তদবির বাণিজ্যে জড়িয়েছে।
তার মতে, এনসিপির নেতারা এখন চাচ্ছেন বিরোধী দল হিসেবে দাঁড়িয়ে সরকারের চাপ এড়িয়ে আবারো সুবিধা পেতে। তবে প্রশ্ন থেকে যায়—জামা’তের সঙ্গে থেকে তারা আদৌ কী অর্জন করতে পারবে?
অলি আহমেদের রাজনৈতিক পরিণতি নিয়ে হতাশা
বিশেষভাবে মন্তব্য আসে অলি আহমেদ (Oli Ahmed) প্রসঙ্গে। মাসুদ কামাল বলেন, “বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত একজন রাজনীতিক আজ জামা’তের সঙ্গে জোট গড়ে তুলছেন—এটা রাজনীতির গভীর দুর্ভাগ্যের প্রতিফলন।”
ভবিষ্যতের জন্য অন্ধকার সম্ভাবনা
তিনি পূর্বাভাস দেন, “এই দল ফ্রিডম পার্টির মতো হারিয়ে যাবে। কারণ আদর্শ নয়, বরং সুবিধা তাদের চালিকা শক্তি।” মাসুদ কামালের মতে, এনসিপি যদি আদর্শিক রাজনীতি করতো, তাহলে আগামী পাঁচ বছর পর নিজেদের রাজনৈতিক ভিত্তি গড়ে তুলতে পারত।
তিনি বলেন, “আমার ধারণা ছিল, এদের মধ্যে রাজনীতি আছে। এখন বুঝি, সেই ধারণাটাও ভুল ছিল। এরা আসলে শর্টকাটে সুবিধা পেতে চাওয়া কিছু মানুষের জমজমাট ক্লাব মাত্র।”
ক্রাউড ফান্ডিং ও দায়বদ্ধতার প্রশ্ন
তাসনিম জারা ও তাজদুবা জাবিন, উভয়েই উল্লেখ করেছেন যে তারা জনগণের কাছ থেকে নির্বাচন সংক্রান্ত ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে টাকা নিয়েছেন। এখন কেউ নির্বাচন না করলে, কেউ দল ত্যাগ করলে, সেই অর্থ ফেরত দেওয়া হবে কি না—এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
তাসনিম জারা জানান, তিনি প্রায় ৪৭ লাখ টাকা সংগ্রহ করেছেন। যারা তার নতুন অবস্থানে সমর্থন না করবেন, তারা চাইলে তিনি তাদের টাকা ফেরত দেবেন। মাসুদ কামাল ব্যঙ্গ করে বলেন, “এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে লাভবান হচ্ছে বিকাশ, কারণ টাকা ট্রান্সফার আর রিফান্ড—দুটোতেই তাদের চার্জ কাটা হচ্ছে।”
শেষ কথা
সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ কামাল এই সমগ্র ঘটনাপ্রবাহকে “রাজনীতির নাটকীয় আত্মপ্রকাশ” বলে অভিহিত করেন। তার মতে, “এনসিপির পতন এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। হয়তো তারা ৩০টা আসন পাবে, হয়তো না-ই পাবে, কিন্তু তাদের রাজনৈতিক ভিত্তি আর বিশ্বাসযোগ্যতা—তা তো গিয়েছে বহু আগেই।”


