গৃহবধূ থেকে আপসহীন নেত্রী— আমাদের একজন “খালেদা জিয়া” ছিলেন

রাজনীতি নিয়ে চিন্তাধারা তো দূরের কথা, রাজনৈতিক কোনো অনুষ্ঠানেও তাঁকে খুব একটা দেখা যেত না। সময়ের পরিক্রমায় সেই তিনিই একজন গৃহবধূ থেকে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে হয়েছেন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। ঘরে-বাইরে নানা ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে তাঁকে এই দীর্ঘ বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে হয়েছেন আপোষহীন নেত্রী , হয়েছেন দেশনেত্রী।

নিভৃত জীবন থেকে রাজনীতির ঝড়ের পথে

খালেদা জিয়া (Khaleda Zia), যাঁকে আজ বাংলাদেশের একজন কিংবদন্তিতুল্য নারী রাজনৈতিক নেতা হিসেবে দেখা হয়, তিনি একসময় ছিলেন নিভৃতচারী গৃহবধূ। তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় এক কঠিন সময় থেকে— ১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান (Ziaur Rahman) এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন। তখন খালেদা জিয়ার বয়স ৩৬ বছর। সেদিন ছিল তাঁর জীবনের মোড় ঘোরানোর মুহূর্ত।

রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁকে জনসম্মুখে তেমন দেখা যেত না। রাষ্ট্রপতির স্ত্রী হিসেবে প্রটোকল রক্ষা করা ছাড়া তাঁর রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ছিল প্রায় শূন্য। কিন্তু স্বামীকে হত্যা করা হলো— একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব শূন্য হয়ে পড়ল— আর সেই জায়গা থেকে শুরু হলো এক নারী নেত্রীর আবির্ভাব।

শৈশব, পরিবার ও শিক্ষা

১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট, বর্তমান পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার চন্দনবাড়ী ইউনিয়নে জন্ম নেন খালেদা জিয়া। পিতা ইস্কান্দার মজুমদার ছিলেন ফেনীর শ্রীপুরের মানুষ, পেশায় ব্যবসায়ী। দেশভাগের পর ব্যবসার সুবাদে দিনাজপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তাঁর মা তৈয়বা মজুমদার ছিলেন সমাজকর্মী। পরিবারটি ‘টি-ফ্যামিলি’ নামে পরিচিত ছিল।

তিন বোন দুই ভাইয়ের মধ্যে খালেদা ছিলেন তৃতীয়। ছোটবেলায় তাঁকে ‘পুতুল’ নামে ডাকা হতো। পড়াশোনার সুযোগ সীমিত হলেও পারিবারিক সংস্কৃতি ও প্রথার মধ্যে গড়ে ওঠেন।

তরুণ সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে জীবন বাঁধা

১৯৬০ সালের ৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে খালেদার বিয়ে হয় দিনাজপুরে, তাঁর নিজ বাড়িতে। সেই বিয়েতে জিয়ার পিতা উপস্থিত থাকতে পারেননি, কারণ তিনি ছিলেন করাচিতে। খালেদার মা ছিলেন জিয়ার মায়ের দূরসম্পর্কের আত্মীয়া, এই সূত্রেই পারিবারিক যোগাযোগ থেকে বিয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

বিয়ের পর তাঁর জীবন কাটে স্বামী ও দুই সন্তান— তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোকে নিয়ে। স্বামীর রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরও তিনি গৃহিণী হিসেবেই জীবন যাপন করেন।

হঠাৎ রাজনীতির ময়দানে

জিয়াউর রহমানের হত্যার পর বিএনপি রাজনৈতিকভাবে দিশেহারা হয়ে পড়ে। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, নেতৃত্বের শূন্যতা, ও সামরিক শাসনের চাপে দলটি এক সময় অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। বিচারপতি সাত্তার রাষ্ট্রপতি হলেও অসুস্থতা ও বার্ধক্যের কারণে কার্যকর নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হন।

এই অবস্থায় বিএনপির তৎকালীন শীর্ষ নেতারা বুঝতে পারেন, দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে হলে এমন একজন নেতার প্রয়োজন, যিনি জিয়ার উত্তরসূরি হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবেন। নানা আলোচনা, বিশ্লেষণ ও অভ্যন্তরীণ বিতর্ক শেষে ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বিএনপিতে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেন খালেদা জিয়া।

দলের দায়িত্ব নেওয়া ও রাজপথে শুরু

১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে খালেদা জিয়া বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন। একই বছরের ১ এপ্রিল দলের বর্ধিত সভায় তিনি জীবনের প্রথম রাজনৈতিক বক্তৃতা দেন। এরপর দায়িত্ব পান দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনের। অবশেষে ১৯৮৪ সালের ১০ মে তিনি দলের পূর্ণ চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।

তাঁর নেতৃত্বেই ১৯৮৩ সালে গঠিত হয় ৭ দলীয় ঐক্যজোট, যার মাধ্যমে শুরু হয় সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন। ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বরে এরশাদের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন আরও তীব্র হয়ে ওঠে।

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ‘আপসহীন’ খালেদা

১৯৮৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিলে বিরোধী জোটে ভাঙন দেখা দেয়। কিন্তু খালেদা জিয়া পিছিয়ে যাননি। ৭ দল, বামদের পাঁচ দল এবং কিছু ইসলামি দলের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে আন্দোলন চালিয়ে যান।

১৯৮৭ সালে তিনি শুরু করেন এক দফা আন্দোলন: “এরশাদ হটাও”। আন্দোলন এতটাই তীব্র রূপ নেয় যে সংসদ ভেঙে দিতে বাধ্য হন এরশাদ। অবশেষে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর, দীর্ঘ আট বছরের আপসহীন সংগ্রামের পর পতন ঘটে এরশাদ সরকারের।

প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইতিহাস গড়া

১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় এবং খালেদা জিয়া হন বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী। তিনি স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায় রচনা করেন। তাঁর জনপ্রিয়তা এতটাই প্রবল ছিল যে তিনি একসঙ্গে পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সবগুলোতেই জয়লাভ করেন।

বিরোধী রাজনীতিতে দৃঢ় অবস্থান

১৯৯৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনের মুখে ষষ্ঠ সংসদ ভেঙে দিয়ে পদত্যাগ করেন। নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপি হয় বিরোধী দল। এরপর ২০০১ সালের ১ অক্টোবর নির্বাচনে আবার বিপুল ভোটে জয়লাভ করে প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া।

‘এক-এগারো’ পটপরিবর্তন ও গ্রেপ্তার

২০০৬ সালের শেষ দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে রাজনৈতিক উত্তেজনা চরমে পৌঁছে যায়। ২০০৭ সালে ‘এক-এগারো’ সরকারের অধীনে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি এক বছর কারাগারে থাকেন। যদিও এর আগেও ১৯৮৩, ১৯৮৪, ১৯৮৭ সালে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে মুক্তি পান। এরপর আবার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। তবে ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পর আন্দোলনের সময় তাঁকে গুলশান কার্যালয়ে ৯৩ দিন ঘেরাও করে রাখা হয়।

নির্বাচনে অবিচল সাফল্য

১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত খালেদা জিয়া মোট ২৩টি সংসদীয় আসনে নির্বাচন করেছেন এবং সবগুলোতেই জয়ী হয়েছেন। এমন নজির দক্ষিণ এশিয়ায় বিরল। ২০১৮ সালে তিনি ফেনী-১, বগুড়া-৬ ও ৭ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাইলেও মিথ্যা দুর্নীতির মামলায় সাজা দিয়ে তাকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়।

জনগণের ভালোবাসা ও ‘দেশনেত্রী’ খেতাব

খালেদা জিয়া দেশের প্রান্তে প্রান্তে সফর করেছেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে মাত্র ১৪ দিনে ১৪ হাজার কিলোমিটার ভ্রমণ করেন তিনি। কখনো রাত তিনটায় নির্বাচনী সভায় বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁর এই শ্রম, নিষ্ঠা ও নেতৃত্বগুণই তাঁকে জনপ্রিয় ‘দেশনেত্রী’তে রূপান্তর করেছে।

ফোর্বস ম্যাগাজিন তাঁকে বিশ্বের ক্ষমতাধর নারীদের তালিকায় ২০০৪ সালে ১৪তম, ২০০৫ সালে ২৯তম, এবং ২০০৬ সালে ৩৩তম স্থান দেয়। ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সি সিনেটে ‘ফাইটার ফর ডেমোক্রেসি’ উপাধিতে তাঁকে সম্মানিত করা হয়।

একটি নাম, একটি ইতিহাস

খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সংগ্রাম কেবল ক্ষমতার জন্য নয়— এটি ছিল এক আধ্যাত্মিক দায়িত্ববোধ থেকে, জনগণের অধিকার রক্ষার দৃঢ় অঙ্গীকার থেকে। তিনি ছিলেন জিয়াউর রহমানের উত্তরসূরি, আবার নিজেই হয়ে ওঠেন বিএনপির অবিচ্ছেদ্য প্রতীক।

গৃহবধূ থেকে হয়ে ওঠা এই ‘আপসহীন নেত্রী’-র জীবন কাহিনি আজ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। শত বছর পরেও আমরা বলতে পারবো আমাদের একজন খালেদা জিয়া ছিলেন —

সে উঠে যায়—সিঁড়ি বেয়ে স্বর্গের দিকে,
যেখানে আর নেই রাজপথের ধুলো, নেই কটুক্তির শব্দ, নেই দীর্ঘ অসুস্থ রাতের যন্ত্রণা।
প্রতিটি ধাপে ধাপে সে রেখে যায় ইতিহাসের ভার,
রেখে যায় অশ্রু, দৃঢ়তা আর এক নারীর নীরব সাহস।

পেছনে পড়ে থাকে কোলাহলমুখর সংসার, ক্ষমতার উত্তাপ,
মিছিলের স্লোগান আর বিরোধের ধারালো ভাষা।
সামনে শুধু আলো—
এক এমন আলো, যেখানে আর প্রশ্ন নেই, অভিযোগ নেই,
শুধু হিসাবহীন বিশ্রাম।

সে উঠে যায়, কারণ তার লড়াই শেষ।
সময় তাকে আর টানে না, রাজনীতি আর ডাক দেয় না।
যারা তাকে ভালোবেসেছে, তারা তাকিয়ে থাকে শূন্য আকাশের দিকে;
আর যারা বিরোধিতা করেছে, তারাও এক মুহূর্ত থমকে যায়—
কারণ এমন প্রস্থান কেবল মানুষের নয়,
একটি যুগের।

সিঁড়ির শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে
সে আর কোনো পরিচয়ে আবদ্ধ নয়—
না প্রধানমন্ত্রী, না নেত্রী, না প্রতিপক্ষ।
সে তখন কেবল একজন মানুষ,
যার কাঁধ থেকে ইতিহাস নিজেই নামিয়ে নিয়েছে তার বোঝা।

সে উঠে যায়—
আর পৃথিবীতে থেকে যায় তার ছায়া,
তার নাম,
তার রেখে যাওয়া এক দীর্ঘ নীরবতা,
যা বহুদিন ধরে কথা বলবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *