স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে যেভাবে ফাটল ধরলো -এবিসি নিউজের মূল্যায়ন

বিগত কয়েক দশক ধরে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশ এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতের মধ্যে ঘনিষ্ঠ ও মৈত্রীপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজমান ছিল। তবে চলতি বছরের শুরু থেকেই উভয় দেশের সম্পর্কের টানাপোড়েন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটার বিরুদ্ধে যে শান্তিপূর্ণ ছাত্র বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল, তা ধীরে ধীরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি ঘটানোর লক্ষ্যে একটি দেশব্যাপী আন্দোলনে রূপ নেয়। এই আন্দোলনকে অনেকে “বিশ্বের প্রথম জেনারেল জেড বিপ্লব” হিসাবে উল্লেখ করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী হাসিনা একটি হেলিকপ্টারে করে দেশ ত্যাগ করেন এবং ভারতে দিল্লিতে আশ্রয় নেন।

পরবর্তী মাসগুলোতে, বাংলাদেশের একজন হিন্দু সন্ন্যাসীর গ্রেপ্তার এবং ভারতের একটি বাংলাদেশি কনস্যুলেটে জনতার হামলার ঘটনাগুলি উভয় দেশের মধ্যে ক্ষোভ ও উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তোলে। এর ফলে, দক্ষিণ এশিয়ার এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে এবং ধর্মীয় উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।

 ‘সহিংসতা আমাদের শত্রু’

‘আয়রন লেডি’ শেখ হাসিনার কট্টর শাসনের অধীনে ভারত দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশকে তার অন্যান্য দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশীদের তুলনায় অনেক বেশি স্থিতিশীল অংশীদার বলে মনে করে এসেছে। আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা সকলেই সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উত্থান-পতনের সাক্ষী থেকেছে । কিন্তু হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামল আগস্টে আকস্মিকভাবে শেষ হওয়ার পর বাংলাদেশে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়, যাকে আবার হাসিনাবিরোধী  বলে মনে করা হয়।  হিন্দুরা বাংলাদেশের ১৭৪ মিলিয়ন জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ এবং তাদের অনেকেই হাসিনার তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছিল।  হাসিনা ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হবার পর দাঙ্গাবাজরা আওয়ামী লীগের প্রতীক এবং কিছু ক্ষেত্রে হিন্দুদের টার্গেট করেছিল। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ডেপুটি এশিয়া ডিরেক্টর মীনাক্ষী গাঙ্গুলী আগস্টে রিপোর্ট করেছেন যে, বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যদের ওপর “হিংসাত্মকভাবে আক্রমণ করা হয়েছে, তাদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে, মন্দির ভাংচুর করা হয়েছে এবং দোকান লুট করা হয়েছে”। 

সেই সময়ে, ইউনূস সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে এই ” সহিংসতার” নিন্দা করেছিলেন।  হামলা বন্ধ না হলে পদত্যাগ করার হুমকি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘সহিংসতা আমাদের শত্রু। দয়া করে আরও শত্রু তৈরি করবেন না। শান্ত হন , দেশ গড়ার জন্য প্রস্তুত হন। ‘তবুও, ভারত  ইউনূসের সরকারের বিরুদ্ধে হিন্দুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য যথেষ্ট পদক্ষেপ না নেয়ার অভিযোগ করেছে। ভারতে নির্বাসিত থেকে হাসিনা দাবি করেছেন, ইউনূস সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে “গণহত্যার” জন্য দায়ী। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং সেপ্টেম্বরে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীকে রাশিয়া-ইউক্রেন, ইসরাইল-গাজার মধ্যে চলমান দ্বন্দ্ব এবং বাংলাদেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির উল্লেখ করে যে কোনো “অপ্রত্যাশিত” পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছিলেন এবং প্রতিবেশী দেশগুলির পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এর মধ্যে নভেম্বরের শেষের দিকে বাংলাদেশে একজন হিন্দু সন্ন্যাসীকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় যা ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে একটি বড় কূটনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টি করে ।

‘স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক’

অক্টোবরে এক সমাবেশে বাংলাদেশের পতাকাকে অসম্মান করার অভিযোগে হিন্দু নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস প্রভুকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু সমর্থকরা বিশ্বাস করেন যে তাকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল কারণ তিনি তার দেশে হিন্দুদের বিরুদ্ধে হামলার বিষয়ে সোচ্চার হয়েছিলেন।  ইউনূস সম্প্রতি একটি ভারতীয় সংবাদ সংস্থাকে বলেছেন যে হিন্দুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার দাবিগুলো ‘অতিরঞ্জিত’ ছিল, যা ভারতে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। ইতিমধ্যে, ভারতে কট্টরপন্থী হিন্দু গোষ্ঠী এবং বাংলাদেশের কট্টরপন্থী মুসলিম গোষ্ঠীগুলো একে ওপরের বিরুদ্ধে  বিক্ষোভ প্রদর্শন করে চলেছে  এবং দু দেশের  সরকার যারা দীর্ঘদিন ধরে উষ্ণ সম্পর্ক উপভোগ করে এসেছে সেই ক্ষতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা জারি রেখেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাসিনা সরকারের পতনের অনেক আগে থেকেই অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে। সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের রিসার্চ ফেলো অমিত রঞ্জন বলেন, “বাংলাদেশিদের মনে  এই অনুভূতি সবসময় থাকে যে , ভারত বাংলাদেশের বিষয়ে খুব বেশি হস্তক্ষেপ করে। হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনকে ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্ট সমর্থন করেছিল বলেও তাদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।’

বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরির গবেষক খন্দকার তাহমিদ রেজওয়ান বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক শুধুমাত্র হাসিনার আওয়ামী শাসনামলের সাথেই  উষ্ণ ছিল, সাধারণ মানুষের সাথে নয় । আমরা বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বলে উপহাস করতাম। ‘ইতিমধ্যে, ভারতের  হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা ইউনূসের কুশপুত্তলিকা পুড়িয়েছে এবং বাংলাদেশের পতাকার অবমাননা করেছে। বিষয়টি বাংলাদেশে ভারতের প্রতি ক্ষোভ দ্বিগুণ  বাড়িয়ে দিয়েছে। ডিসেম্বরের শুরুতে প্রায় ৫০ জন বিক্ষোভকারী উত্তর-পূর্ব ভারতের শহর আগরতলায় বাংলাদেশি কনস্যুলেটে প্রবেশ করে বিক্ষোভ দেখায় । ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সাত বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করেছে এবং ঘটনাটিকে “গভীরভাবে দুঃখজনক” বলে উল্লেখ করেছে। এই মাসের শুরুর দিকে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি   ড. ইউনূসের সঙ্গে দেখা করতে এবং সম্পর্কের বরফ গলাতে ঢাকায় গিয়েছিলেন।  আগস্টে হাসিনা দিল্লিতে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে এটি ছিল দুই দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ের সফর।

প্রত্যর্পণের প্রশ্ন

ড. ইউনূস বলেছেন, বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচন হবে ২০২৫ সালের শেষের দিকে বা ২০২৬ সালের শুরুতে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), যারা  হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে  সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল তাদের সরকার গড়ার সম্ভাবনা প্রবল। প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা জেনসের সিনিয়র বিশ্লেষক শিবানী গায়কোয়াড় বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন গঠনের পর থেকে বিএনপি তার চীনপন্থী অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে। বিএনপি তার চীনপন্থী এবং ইসলামপন্থী অবস্থান নিয়ে ক্ষমতায় আসলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। ‘আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো , অক্টোবরে বাংলাদেশের একটি ট্রাইব্যুনাল অন্যান্য অভিযোগের পাশাপাশি মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য  হাসিনার বিরুদ্ধে  গ্রেপ্তারি  পরোয়ানা জারি করেছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরির গবেষক রেজওয়ান মনে করেন ,’হাসিনাকে প্রত্যাবাসনের যে কোনও প্রচেষ্টা ভারতের ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি এবং বিরোধী কংগ্রেস পার্টি উভয়ের  দ্বারা প্রতিরোধের সম্মুখীন  হবে। কারণ ভারতও চাইবে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ পুনর্গঠন করুক এবং মূলধারার রাজনীতিতে ফিরে আসুক। ‘তবুও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভবিষ্যত নির্ভর করছে ভারত সরকার শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের কাছে  হস্তান্তর করতে প্রস্তুত কিনা তার উপর।

অস্ট্রেলিয়ায় সাত বছর নির্বাসনের পর বাংলাদেশের শিক্ষাবিদ ও মানবাধিকার কর্মী মোবাশ্বর হাসান তার জন্মভূমিতে ফিরে আসেন হাসিনার পতনের পর। ড. হাসান এবিসির দ্য ওয়ার্ল্ডকে বলেছেন যে, ‘ভারত যদি তাকে প্রত্যর্পণ করতে অস্বীকার করে, তাহলে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণভাবে ভারতবিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি পাবে “।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *