অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের প্রত্যাশা ও চাপ থাকলেও বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন চিত্র উপস্থাপন করছে। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই সরকার বিভিন্ন কমিশন ও টাস্কফোর্স গঠন করলেও, সেগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়নের অগ্রগতি প্রশ্নবিদ্ধ। ফলে সংশ্লিষ্ট মহলে সংস্কার কার্যক্রমের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর ব্র্যাক ইন-এ আয়োজিত দুই দিনব্যাপী সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশনে এই বিষয়টি বিশেষভাবে উঠে আসে। ‘অর্থনীতির পুনঃকৌশলকরণে টাস্কফোর্সের সুপারিশ’ শীর্ষক এ সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, গঠিত কমিশন ও টাস্কফোর্সের সুপারিশ বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারের ওপর বর্তায়। সাত মাস পেরিয়ে যাওয়ার পর এখন সময় এসেছে জিজ্ঞাসা করার— সংস্কারের কতগুলো সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়েছে এবং কতগুলো এখনো অনিষ্পন্ন।
অধ্যাপক রেহমান সোবহান আরও বলেন, শুধুমাত্র একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থা নিশ্চিত করাই যথেষ্ট নয়; বরং বিদ্যমান বাস্তবতার আলোকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার প্রতিটি স্তরে ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। সরকারের দায়িত্ব ছিল এই সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করা। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার পরও উল্লেখযোগ্য কিছু সংস্কারকাজ সম্পন্ন করা হয়নি, যা এখনো ঝুলে আছে। সরকারের উচিত ছিল এই সংস্কারগুলোর অগ্রগতি পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের কাছে স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করা।
সংস্কার বাস্তবায়ন ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজনীয়তা
তিনি আরও উল্লেখ করেন যে নির্বাচিত সরকার ও অন্তর্বর্তী সরকারের বাস্তবতা এক নয়। সংস্কার বাস্তবতা যেমনই হোক, নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে সংশ্লিষ্ট সংস্কারসমূহ বাস্তবায়নের জন্য নীতিগত সংলাপ ও অ্যাডভোকেসি চালিয়ে যেতে হবে। প্রয়োজনে এ লক্ষ্যে একটি পৃথক কমিশন গঠন করা যেতে পারে।
হাসিনা সরকারের পতনের পর নতুন বাস্তবতায়, দেশে বৈষম্যহীন ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ এবং প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণের জন্য গঠিত টাস্কফোর্স সরকারের কাছে যে সুপারিশ পেশ করেছে, সেগুলোর পর্যালোচনা ও বাস্তবায়ন পরিস্থিতি পর্যালোচনার উদ্দেশ্যে সিপিডির পক্ষ থেকে এ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
টাস্কফোর্সের সুপারিশ বাস্তবায়নে সীমাবদ্ধতা
গত ১১ সেপ্টেম্বর সরকার কর্তৃক ১২ সদস্যের টাস্কফোর্স গঠিত হয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর সাবেক মহাপরিচালক কে এ এস মুর্শিদ। অধিবেশনে তিনি বলেন, টাস্কফোর্স প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠার একটি বিশদ প্রতিবেদন সরকারের কাছে উপস্থাপন করলেও, তা যথাযথভাবে পর্যালোচনা করা হয়নি। উপদেষ্টাদের কেউ কেউ এমনকি বলেছেন, তাঁদের পড়ে বুঝিয়ে দিতে হবে। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি যদি বাস্তবতা হয়, তবে এত বড় উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে।
দুর্নীতি ও রাজনৈতিক সংস্কারের গুরুত্ব
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দখলবাজি, মামলা ও জামিন বাণিজ্যে বৈষম্যবিরোধী ব্যক্তিরাও আকৃষ্ট হচ্ছেন, কারণ তাঁদের সামনে কোনো আদর্শিক দিকনির্দেশনা নেই। তিনি আরও বলেন, ৫ আগস্টের পর দখলবাজি ও চাঁদাবাজির মাত্রা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে— কেবলমাত্র রাজনৈতিক ব্যানার পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু দুর্নীতির ধরন অপরিবর্তিত রয়ে গেছে।
তিনি উল্লেখ করেন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এর তদন্ত স্থগিত রাখার জন্য রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর প্রচেষ্টা চলছে। অতীতেও রাজনীতিবিদ, আমলাতন্ত্র ও ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ে গঠিত ত্রিমুখী ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণে দেশ পরিচালিত হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যথাযথ সংস্কার না হলে, এ অবস্থার উন্নতি সম্ভব নয়। মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ও বৈষম্যবিরোধী চেতনা যদি রাজনৈতিক দলগুলো আত্মস্থ করতে পারে, তবে তাদের নিজেদের মধ্যেই কাঙ্ক্ষিত সংস্কার আনতে হবে।
শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা
সম্মেলনের এক অধিবেশনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানুল্লাহ বলেন, “তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষকদের দ্বারা প্রথম শ্রেণির নাগরিক গঠন সম্ভব নয়।” তিনি উল্লেখ করেন, প্রাথমিক শিক্ষকদের তৃতীয় শ্রেণির মর্যাদায় রাখা হয়েছে, অথচ তাঁদের দায়িত্ব হলো ভবিষ্যৎ নাগরিক গড়ে তোলা।
তিনি আরও বলেন, বেসরকারি কলেজ শিক্ষকরাও আর্থিক সুবিধার দিক থেকে পিছিয়ে আছেন। একজন শিক্ষক যখন অনার্স-মাস্টার্স পর্যায়ে শিক্ষাদান করছেন, অথচ তাঁকে এমপিও দেওয়া হচ্ছে না, তখন প্রশ্ন ওঠে— কেন তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হলো? তিনি অভিযোগ করেন যে অনেক ক্ষেত্রে ১০-১৫ লাখ টাকা ঘুষের মাধ্যমে চাকরি প্রদান করা হচ্ছে, কিন্তু পরবর্তীতে তাঁদের এমপিও দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
উপাচার্য আরও বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার কার্যক্রম চলছে, কিন্তু গুণগত মান নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। এর অন্যতম কারণ হলো, কোনো পর্যবেক্ষণ বা পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত শিক্ষক না থাকা। তিনি বলেন, ৮-১০ হাজার টাকা বেতনে একজন শিক্ষক অনার্স পর্যায়ে পাঠদান করছেন, যা শিক্ষার মানোন্নয়নে কোনোভাবেই যথেষ্ট নয়।
উপসংহার
সম্মেলনে বক্তারা একমত হন যে, টাস্কফোর্স ও কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কার সাধন, দুর্নীতি রোধ এবং শিক্ষাব্যবস্থায় কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন ছাড়া সামগ্রিক রাষ্ট্রীয় অগ্রগতি সম্ভব নয়। সরকারের উচিত এ বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা এবং সময়মতো সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা, যাতে ভবিষ্যতে উন্নয়নের গতি বাধাগ্রস্ত না হয়।