বাংলাদেশে ২০২৩ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে সংঘটিত সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের (OHCHR) প্রতিবেদন জেনেভায় জাতিসংঘের সদস্যদের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময় বুধবার (৫ মার্চ) সন্ধ্যা ৬টার পর জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক (Volker Türk) এই প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন। জেনেভা থেকে সংস্থাটির ইউটিউব চ্যানেলে অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
প্রতিবেদনে উল্লেখযোগ্য বিষয়
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার ওপর তৎকালীন সরকার ও ক্ষমতাসীন দল ব্যাপক দমন-পীড়ন চালিয়েছে।
- বিক্ষোভ চলাকালে প্রায় ১,৪০০ জন নিহত হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই মিলিটারি রাইফেল ও প্রাণঘাতী মেটাল প্যালেটস লোড করা শটগানের আঘাতে মারা যান।
- ১১,৭০০ জনেরও বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার ও আটক করা হয়েছে, যা পুলিশ ও র্যাবের তথ্য অনুযায়ী জানা গেছে।
- নিহতদের মধ্যে প্রায় ১২-১৩ শতাংশ ছিল শিশু। নিরাপত্তা বাহিনী শিশুদের টার্গেট করে হত্যা করেছে এবং অনেককে পঙ্গু করেছে।
- নারীরা ব্যাপকভাবে যৌন ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। নিরাপত্তা বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরা নারীদের আক্রমণ করেছে, ধর্ষণের হুমকি দিয়েছে এবং যৌন সহিংসতায় লিপ্ত হয়েছে।
জাতিসংঘের উদ্বেগ ও সুপারিশ
জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক বলেন, “গত বছর বাংলাদেশে সহিংসতার ফলে এক বিশাল বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। তৎকালীন সরকার ছাত্র আন্দোলনকে নৃশংসভাবে দমন করেছে, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের চরম উদাহরণ।”
তিনি আরও বলেন, “ফৌজদারি মামলায় যথাযথ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা ও সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক সহিংসতার তদন্ত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
ভলকার তুর্ক আশা প্রকাশ করেন, এই প্রতিবেদন বাংলাদেশে জবাবদিহিতা, ক্ষতিপূরণ এবং মানবাধিকার সংস্কারের জন্য কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশ সরকারের প্রতিক্রিয়া
এই প্রতিবেদন উপস্থাপনের সময় অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল (Asif Nazrul)।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশে জবাবদিহিতা, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার সংস্কারের লক্ষ্যে তথ্য অনুসন্ধান ও সুপারিশ নিয়ে সদস্য রাষ্ট্র ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে আলোচনা প্রয়োজন।”
বিক্ষোভ ও দমনপীড়ন: জাতিসংঘের তদন্তের ফলাফল
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, গত বছরের বিক্ষোভ দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরা ব্যাপক সহিংসতা চালিয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে:
- বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারী ছাত্র ও কর্মজীবীদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করা হয়েছে।
- নারীদের বিরুদ্ধে শারীরিক ও যৌন সহিংসতা চালানো হয়েছে।
- প্রতিবাদকারীদের ওপর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে।
মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িতদের চিহ্নিতকরণ
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠন, নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা এই সহিংসতায় জড়িত ছিলেন।
জাতিসংঘের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে যে:
- পুলিশ ও র্যাবের গুলিতে বিক্ষোভকারীরা নিহত হয়েছেন।
- শিশুদের ওপর সহিংসতা চালানো হয়েছে, এবং অনেককে গ্রেপ্তার করে অমানবিক নির্যাতনের শিকার করা হয়েছে।
- শুরুর দিকে বিক্ষোভের সম্মুখসারিতে থাকা নারীরা ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের দ্বারা ভয়াবহ নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের এই প্রতিবেদন বাংলাদেশে ২০২৩ সালের রাজনৈতিক সহিংসতা ও দমনপীড়নের ভয়াবহতা তুলে ধরেছে। জাতিসংঘ এই ঘটনার যথাযথ তদন্ত, বিচার এবং ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সুপারিশ করেছে।