তৌহিদী জনতার আড়ালে এরা কারা?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (DU) এক ছাত্রীর হেনস্তার ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে নিতে শাহবাগ থানায় সংঘটিত উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি এবং একাধিক স্থানে ভাঙচুরের ঘটনায় নতুন তথ্য উঠে এসেছে। সাংবাদিক কদরুদ্দিন শিশির (Kadruddin Shishir) এ নিয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন, যেখানে এই ঘটনার নেপথ্যে থাকা বিভিন্ন গোষ্ঠীর ভূমিকা ও তাদের সংযোগ তুলে ধরা হয়েছে।

শাহবাগের ঘটনায় পরিকল্পিত সংযোগের ইঙ্গিত

অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, শাহবাগের এই ঘটনা কোনো স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ নয়, বরং এটি পূর্বপরিকল্পিত এবং সুসংগঠিত। ফ্যাক্টচেকার কদরুদ্দিন শিশির (Kadruddin Shishir) তার এক ফেসবুক পোস্টে জানান, সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া তিনটি ঘটনার সঙ্গে এই ঘটনার মিল রয়েছে।

এই তিনটি ঘটনা হলো:

  1. প্রথম আলো (Prothom Alo) অফিসের সামনে দু’দিনব্যাপী বিক্ষোভ ও গরু কোরবানি কর্মসূচি।
  2. দ্য ডেইলি স্টার (The Daily Star) কার্যালয়ের গেটে বিক্ষোভ ও জুমার নামাজ আদায়।
  3. শাহবাগ থানায় গিয়ে নারী হেনস্তাকারীকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা।

এই তিনটি ঘটনায় কয়েকশ’ মানুষকে একত্রিত করা হয়েছিল এবং প্রতিবারই সামনের সারিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন অন্তত তিনজন ব্যক্তি, যাদের মধ্যে দু’জনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে।


নেতৃত্বে কারা ছিলেন?

আবু সাঈদ শের মোহাম্মদ খান

একজন হলেন আবু সাঈদ শের মোহাম্মদ খান, যিনি অনলাইন শরিয়াহ গ্রাজুয়েশন ইনস্টিটিউটের পরিচালক। ২০২২ সালে তিনি জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়া‘র জন্য অর্থ সরবরাহকারী সদস্য হিসেবে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ২০১৫ সালে হাটহাজারী‘তে তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা হয়।

তার কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে:

  • প্রথম আলোদ্য ডেইলি স্টার কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভে নেতৃত্ব প্রদান।
  • আল-কায়দার পতাকা সমর্থন ও প্রচার।
  • সাম্প্রতিক শাহবাগের ঘটনার সময় তাকে ‘আমীর’ ঘোষণা করেন আরেক উগ্রপন্থী নেতা আতাউর রহমান বিক্রমপুরী

আতাউর রহমান বিক্রমপুরী

দ্বিতীয় ব্যক্তি আতাউর রহমান বিক্রমপুরী, যিনি বিক্ষোভ ও থানায় হামলার ঘটনায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

তার সম্পর্কে জানা গেছে:

  • তিনি তার বক্তব্য ও সামাজিক মাধ্যমে চরমপন্থী উসকানিমূলক প্রচার চালান।
  • তিনি বায়তুল মোকাররম (Baitul Mukarram) মসজিদের খতিব মাওলানা আব্দুল মালেক-কে ‘মুনাফেক’ এবং ‘তাগুতের কুকুর’ বলে অভিহিত করেন।
  • এন্টি শাতিম মুভমেন্ট নামে একটি ফেসবুক পেজ পরিচালনা করেন, যেখানে ইসলাম অবমাননার অভিযোগে হত্যার আহ্বান জানানো হয়।
  • তিনি নিয়মিতভাবে গণতন্ত্র চর্চাকারী মুসলমানদের ‘কাফির’ বলে অভিহিত করেন এবং নাস্তিকদের হত্যা করতে উস্কানি দেন।
  • ২০২১ সালে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম‘র সদস্য হিসেবে গ্রেপ্তার হন।

তৃতীয় ব্যক্তি

শাহবাগের ঘটনার নেতৃত্বে থাকা তৃতীয় একজন ব্যক্তির পরিচয় এখনও অজানা। তবে তিনি আগের দুই ব্যক্তির সঙ্গে থেকেই ঘটনাগুলো পরিচালনা করেছেন বলে জানা গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবিরের প্রতিক্রিয়া

এই ঘটনার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ইসলামী ছাত্রশিবির (Islami Chhatra Shibir DU Unit) এই ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে। সংগঠনের শাখা সম্পাদক মহিউদ্দিন খান বলেন,

“একজন হ্যারাসারকে যখন মুসলমানরাই ইসলামের প্রতীক বানিয়ে ফেলে, এটি ইসলামের জন্য অপমানজনক। যারা অপরাধীকে বীর হিসেবে উপস্থাপন করেছে, তাদের কর্মকাণ্ডের খেসারত মুসলিম সমাজকে দিতে হবে।”

ঢাবি শাখার সাবেক সভাপতি আবু সাদিক কায়েম মন্তব্য করেন,

“বাংলাদেশকে একটি নিরাপদ ও শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে চাইলেও কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী বারবার ষড়যন্ত্র করছে। অপরাধীকে কেন্দ্র করে উদযাপন করা জাতীয় মূল্যবোধের অবমাননা এবং আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।”

শাহবাগ থানায় শিবির নেতাদের অবস্থান

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবিরের সভাপতি এসএম ফরহাদ তার এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে থানায় যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন,

“শাহবাগ থানার ওসি রাত ১টার দিকে ফোন করে জানান যে, পরিস্থিতি সংকটপূর্ণ, এবং অপরাধীকে ছাড়িয়ে নিতে লোকজন থানার সামনে অবস্থান নিয়েছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও ভুক্তভোগী ছাত্রীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি। পরে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও অন্যান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে সমন্বয় করে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করি।”

তিনি আরও জানান,

“থানায় উপস্থিত লোকজন দাবি করছিল যে, অভিযুক্ত অর্ণবকে আদালতে নেওয়া যাবে না, বরং এখানেই মুক্তি দিতে হবে। তারা একসঙ্গে হাত ধরে শপথ করছিল যে, প্রয়োজনে জীবন দিয়ে হলেও তারা সরবে না।”

শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন পক্ষের প্রচেষ্টায় পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয় এবং আইনি প্রক্রিয়া মেনে অভিযুক্তকে আদালতে নেওয়া সম্ভব হয়।

উগ্রপন্থী সংগঠনের সক্রিয়তা নিয়ে উদ্বেগ

এই ঘটনাগুলো নিয়ে বিশ্লেষকদের দাবি, এটি একটি সুপরিকল্পিত উগ্রপন্থী চক্রের অপতৎপরতার অংশ। সমাজে বিভ্রান্তি ছড়াতে এবং আইনের শাসনকে চ্যালেঞ্জ জানাতে এসব গোষ্ঠী সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত, এ ধরনের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া এবং সমাজে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারীদের আইনের আওতায় আনা।


Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *