সংবিধান সংস্কারে ২৫ দফায় একমত, ২৫ দফায় আংশিকভাবে একমত বিএনপি, রবিবার ফের বসছে সংলাপ

সংবিধান সংস্কার নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আয়োজিত সংলাপে অংশ নিয়ে সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত ২৫টি সুপারিশে একমত হয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। এছাড়া আরও ২৫টি প্রস্তাবে দলটি আংশিকভাবে একমত হয়েছে। তবে বাকি ১৬ টি প্রস্তাব নিয়ে রয়েছে তাদের দ্বিমত। বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদের এলডি কনফারেন্স হলে প্রায় ছয় ঘণ্টাব্যাপী এই সংলাপে অংশ নেয় বিএনপির প্রতিনিধি দল। আলোচনার পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, আগামী রবিবার আবারো একই ইস্যুতে সংলাপে বসবে দুই পক্ষ।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে হওয়া এই সংলাপে সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার। অংশ নেন কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য বিচারপতি এমদাদুল হক, বদিউল আলম মজুমদার, ড. ইফতেখারুজ্জামান ও সফর রাজ হোসেন।

বিএনপির পক্ষ থেকে সংলাপে উপস্থিত ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাঈল জবিউল্লাহ, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল এবং আবু মো. মনিরুজ্জামান খান।

“গণতন্ত্র বারবার হোঁচট খেয়েছে” — আলী রীয়াজ

সংলাপের শুরুতেই অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, জাতীয় সনদ তৈরির মাধ্যমে দেশে একটি স্থায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাই আমাদের লক্ষ্য। তিনি বলেন, “এই দেশে কেবল গণতন্ত্রই হোঁচট খায়নি, বরং ব্যক্তিতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রও বারবার মাথাচাড়া দিয়েছে। বিএনপি সেই স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে অন্যতম অগ্রসেনানী ছিল।”

তিনি জানান, বিএনপি সংবিধান সংস্কার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট মত দিয়েছে এবং ভিন্ন মত নিয়েও আলোচনায় আগ্রহ দেখিয়েছে।

“বিএনপি স্পষ্ট বার্তা দিতে চায়” — সালাহউদ্দিন

বৈঠক শেষে সালাহউদ্দিন আহমেদ জানান, কমিশনের প্রাথমিক প্রতিবেদনে ১৩১টি প্রস্তাব থাকলেও আলোচনার সময় ৭০টি বিষয়ের স্প্রেডশিট দেওয়া হয়। তিনি বলেন, “আমরা ২৫টি প্রস্তাবে সম্পূর্ণ একমত, আরও ২৫টির মতো প্রস্তাবে আংশিক একমত হয়েছি। কিছু বিষয়ে এখনো মতপার্থক্য রয়েছে।”

তবে স্প্রেডশিটে শুধুই ‘হ্যাঁ-না’ উত্তরের সুযোগ থাকায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন সালাহউদ্দিন। “আমরা যে বিষয়গুলোতে মত দিয়েছি, কমিশনকে যুক্তি দিয়ে তা বোঝানোর চেষ্টা করেছি,” বলেন তিনি।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়েও স্পষ্ট অবস্থান তুলে ধরে সালাহউদ্দিন বলেন, “সংবিধানের ৯৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন ছাড়া সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় বা বিচারক নিয়োগের কোনো নতুন কাঠামো অসাংবিধানিক হতে পারে। আমরা আইনানুগ সংস্কার চাই।”

নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারে গুরুত্ব

সংলাপে নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়েও বিস্তর আলোচনা হয়। সালাহউদ্দিন আহমেদ জানান, “কমিশনের বেশ কিছু প্রস্তাব বাস্তবায়ন করলে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। তবু আমরা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রেখেই এগোচ্ছি।”

তিনি বলেন, “এনআইডি, ভোটার তালিকা বা সীমানা নির্ধারণের মতো বিষয় নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণেই থাকা উচিত।”

“সংস্কারের ইতিহাসে বিএনপি-ই অগ্রগামী” — নজরুল ইসলাম খান

বিএনপির আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, “বিএনপির চেয়ে বেশি সংস্কার বাংলাদেশে আর কোনো দল করেনি। খালেদা জিয়া যখন ভিশন-২০৩০ দিয়েছেন, তখন অনেকে সংস্কারের ‘স’ উচ্চারণও করেননি।”

তিনি আরও বলেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকার, ভ্যাট ব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন, মুক্তবাজার অর্থনীতি—সবকিছুর গোড়াপত্তন বিএনপির হাত ধরেই। আমরা শুধু কথায় নয়, বাস্তব সংস্কার করেছি।”

নজরুল আরও বলেন, “সংস্কার একটা চলমান প্রক্রিয়া। যেমন একটি ঘরে সদস্য বাড়লে সেটআপ বদলায়, তেমনি সমাজ বা রাষ্ট্রেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন আসবেই।”

ঐকমত্য গঠনের পথে এগোচ্ছে সংলাপ

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগে গত ২০ মার্চ থেকে শুরু হওয়া এই সংলাপে এখন পর্যন্ত ১১টি দলের সঙ্গে আলোচনা শেষ হয়েছে। বিএনপি ২৩ মার্চ লিখিতভাবে মত জমা দেয়। এ পর্যন্ত ৩৫টি দল বা জোট লিখিত মত দিয়েছে।

রবিবারের বৈঠকে আরও অগ্রগতি আশা করছে দুই পক্ষই। বিএনপির ভাষ্য—তারা দেখাতে চায় যে, “সংস্কার নিয়ে তারা কতটা আন্তরিক ও প্রস্তুত।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *