জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ নিয়ে প্রায় ছয় ঘণ্টার ম্যারাথন আলোচনায় বসেছিল বিএনপি (BNP) এবং কমিশন। কিন্তু এত দীর্ঘ আলোচনার পরও অনেক প্রস্তাবে এখনো ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা খর্ব করতে প্রস্তাবিত জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (National Constitutional Council) বা এনসিসি গঠনের প্রস্তাবটি বিএনপি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ১১টা থেকে বিকেল পৌনে ৫টা পর্যন্ত জাতীয় সংসদ ভবনে কমিশনের কার্যালয়ে বৈঠক চলে। প্রথম দফায় আলোচনায় সংবিধান এবং বিচার বিভাগসংক্রান্ত সংস্কারের ওপর আংশিক আলোচনা হলেও, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন ও দুদক (Anti-Corruption Commission) নিয়ে আলোচনা হয়নি।
কমিশনের ৭০টি সংবিধান সংশোধনী প্রস্তাবনার মধ্যে বিএনপি মাত্র ১৪টিতে একমত হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। বিচার বিভাগের ২৩টি সংস্কার সুপারিশের মধ্যে ২০টিতে দলটির সম্মতি থাকলেও কিছু প্রস্তাবে নতুন করে ভাবনার কথা জানিয়েছে। বিচার বিভাগ নিয়ে বিএনপির ভিন্নমত থাকা প্রস্তাবগুলো আলোচনায় এসেছে। কমিশন বলছে, যদিও বিএনপি তাদের অবস্থান পুরোপুরি পরিবর্তন করেনি, আলোচনাটি ফলপ্রসূ ছিল। তারা বিএনপির প্রতিটি দ্বিমতের কারণ শুনেছে এবং তা নোট করেছে।
অন্যদিকে, বিএনপির পক্ষ থেকে স্পষ্ট জানানো হয়েছে যে সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা কেবলমাত্র নির্বাচিত সংসদের আছে। কমিশন বা অন্য কোনো অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এটি করতে পারে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রজাতন্ত্র, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, মৌলিক অধিকার এবং বিচার বিভাগের কিছু অংশ নিয়ে আলোচনা করেছি। কিছু বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, আবার কিছু বিষয়ে দলীয়ভাবে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত জানানো হবে।”
বিচারক নিয়োগ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে বিএনপি বলেছে, সংবিধানের ৯৫ এবং ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন না করে সরকার যেভাবে অধ্যাদেশ জারি করেছে তা অসাংবিধানিক। কমিশনের প্রতিবেদনে এ বিষয়গুলো নিয়ে ‘মিস লিডিং’ তথ্য আছে বলেও তারা অভিযোগ করেছে।
জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের যে সুপারিশ এসেছে, সেটি নিয়ে বৃহস্পতিবার আলোচনা হয়নি বললেও বিএনপি শুরুতেই এ ধারণার বিরোধিতা করেছে। তারা বলছে, এই প্রস্তাবের বাস্তব কোনো দৃষ্টান্ত দেশে নেই, বরং এটি সংসদ ও নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা খর্ব করতে পারে। সংসদ না থাকাকালে এনসিসির মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার ঝুঁকি নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে দলটি।
ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়েও তীব্র মতপার্থক্য দেখা গেছে। বিএনপি চাইছে, ১৫তম সংশোধনীর আগের সংবিধানের মূলনীতি—‘আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস’—ফিরিয়ে আনতে। বহুত্ববাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার বিপক্ষে অবস্থান জানিয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমরা পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্যে থাকা ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং জাতীয়তাবাদকে সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে দেখতে চাই।”
বিএনপি আরও বলেছে, গণভোটের বিষয়টি সব সংবিধান সংশোধনের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে না। ১৪২ অনুচ্ছেদ সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোট দরকার হলেও, অন্যান্য অনেক বিষয়ে সেটা প্রযোজ্য নয়।
আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা—নজরুল ইসলাম খান, সালাহউদ্দিন আহমেদ, ইসমাইল জবিউল্লাহ, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল এবং সাবেক সচিব আবু মো. মনিরুজ্জামান। কমিশনের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, ড. ইফতেখারুজ্জামান, বিচারপতি এমদাদুল হক, বদিউল আলম মজুমদার এবং মনির হায়দার।
কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, “গণতন্ত্র বারবার হোঁচট খেয়েছে। জাতীয় সনদের মাধ্যমে আমরা একটি স্থায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথ খুঁজছি। বিএনপির মতো একটি বড় রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে আলোচনা ইতিবাচক। আশা করি, পরবর্তী বৈঠকে আরও অগ্রগতি হবে।”
বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম খান আলোচনার সূচনা বক্তব্যে বলেন, “সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। বিএনপিই প্রথম দেশে বহু দলে গণতন্ত্র, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, গ্রাম সরকার, ভ্যাট ব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমন কমিশন চালু করেছে। আমরা সংস্কারের পক্ষে।”
আগামী রোববার সকাল ১১টায় আবারও কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে বসবে বিএনপি। তাতে বাকি প্রস্তাবনা, বিশেষ করে নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন এবং দুর্নীতি দমন কমিশন নিয়ে আলোচনা হবে বলে জানিয়েছেন বিএনপির নেতারা।