শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের পুনর্গঠন: আল জাজিরার তথ্যচিত্রে উঠে এলো দুঃশাসনের করালচিত্র

আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত একটি তথ্যচিত্রে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘ একনায়কতান্ত্রিক শাসনামলের নানা দিক তুলে ধরেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা (Al Jazeera)। ‘রিবিল্ডিং বাংলাদেশ ডেমোক্রেসি আফটার শেখ হাসিনা’ শিরোনামের তথ্যচিত্রটি ২ মে প্রকাশিত হয়, যেখানে ফুটে উঠেছে কিভাবে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে তিনি দেশত্যাগে বাধ্য হন।

তথ্যচিত্রে তুলে ধরা হয়, কীভাবে আওয়ামী লীগ (Awami League) সরকারের আমলে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে বিরোধী মতকে নির্মমভাবে দমন করা হয়েছিল। ১৫ বছরের শাসনকালে র‌্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে ব্যবহারের মাধ্যমে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গুম, খুন ও নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে।

তথ্যচিত্রের কেন্দ্রে রয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস (Muhammad Yunus), যিনি শেখ হাসিনার পতনের পর গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। একইসঙ্গে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান (Waqar Uz Zaman) এবং নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের বক্তব্যের মাধ্যমে হাসিনা আমলের নির্দয় বাস্তবতা ফুটে ওঠে।

তথ্যচিত্র অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণভবন ঘেরাওয়ের সময় শেখ হাসিনা হেলিকপ্টারে চড়ে দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেন। এর আগে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সূত্র ধরে শুরু হওয়া ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ ক্রমেই জাতীয় অভ্যুত্থানে রূপ নেয়, যেখানে আওয়ামী লীগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে শত শত মানুষ নিহত হন।

নির্যাতনের শিকার হুম্মাম কাদের চৌধুরী জানান, তার বাবার মৃত্যুর নয় মাস পর তাকেও গুম করা হয় এবং ‘আয়নাঘর’ নামের একটি অন্ধকার কক্ষে আটকে রাখা হয়। তিনি বলেন, “এই ঘরটা এমন, যেখানে আপনি কাউকে দেখতে পান না। নিজেকেও হারিয়ে ফেলেন।”

এমনই আরেক ভুক্তভোগী অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা আবদুল্লাহিল আমান আযমী, যাকে আট বছর বিনা বিচারে আটক রেখে ২০২৪ সালের আগস্টে হঠাৎ ছেড়ে দেয়া হয়। তিনি জানান, “৬৯ হাজার ৭৯৪ ঘণ্টা আমি প্রকৃতির কোনো আলো দেখি নাই।” ২০০৯ সালে কোনো কারণ ছাড়াই চাকরি থেকে অব্যাহতি পান এই সাবেক ব্রিগেডিয়ার।

তথ্যচিত্রে সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ অবস্থানের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান আল জাজিরাকে বলেন, “আমরা নাগরিকদের দিকে গুলি চালাই না, এটা আমাদের সংস্কৃতির অংশ নয়।” তিনি আরও বলেন, “আমরা চেয়েছি কম রক্তপাতের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার পরিবর্তন হোক।”

প্রকাশিত তথ্যচিত্রে প্রমাণ হিসেবে হাজির করা হয়েছে আর্থিক দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র। অন্তর্বর্তী সরকারের ভাষ্যমতে, বিগত সরকারের মন্ত্রী ও ঘনিষ্ঠরা বাংলাদেশ থেকে অন্তত ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছেন। অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর (Ahsan H. Mansur) বলেন, “হাসিনার শাসনব্যবস্থা আক্ষরিক অর্থেই ব্যাংক ডাকাতির মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে।” তিনি জানান, “মনে হয় রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকা অবস্থাতেই কিছু মানুষ অস্তিত্বহীন কোম্পানিকে কোটি কোটি টাকা ঋণ দেয়ার আদেশ করেছে।”

আল জাজিরার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী (Saifuzzaman Chowdhury)-এর বার্ষিক সরকারি বেতন ১৫ হাজার ডলারের কম হলেও লন্ডনে তার মালিকানায় রয়েছে অর্ধ মিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পত্তি। এ ধরনের আরও অনেক সাবেক মন্ত্রী-এমপি এখন বিদেশে বিলাসী জীবনযাপন করছেন।

তথ্যচিত্রে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের বিচার ব্যবস্থার সংস্কার, প্রশাসনিক শুদ্ধিকরণ এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ। আল জাজিরার মতে, শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনের অবসান ঘটিয়ে এই সরকার নতুন এক সম্ভাবনার সূচনা করেছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *