সর্বত্র অস্থিরতা, চাপে ইউনূস—নতুন মোড় নিচ্ছে দেশের রাজনীতি

দেশজুড়ে এক অস্বাভাবিক অস্থিরতা ও বিদ্রোহের আবহ তৈরি হয়েছে। রাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে পড়েছে ক্ষোভ, অসন্তোষ ও চরম অসহিষ্ণুতা। ব্যবসায়ীরা প্রকাশ্যে সরকারের বিরুদ্ধে রূঢ় সুরে কথা বলছেন, যা আগে কখনও দেখা যায়নি। এমনকি রাজনৈতিক বক্তৃতায় অশালীন ভাষার ব্যবহারও চোখে পড়ছে—একজন প্রভাবশালী ইউনূসকে কটাক্ষ করে অশ্লীল তুলনা করেছেন, যা রাজনৈতিক মেজাজের গভীর পরিবর্তনের প্রতিফলন।

এই উত্তপ্ত পরিবেশে মুহাম্মদ ইউনূস (Muhammad Yunus) দৃঢ়ভাবে অবস্থান নিচ্ছেন। তার চারপাশে যখন কাঠামোগত বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে, তখনও তিনি নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। বিশ্বব্যাপী সম্মানিত এই অর্থনীতিবিদের মুখে কোনো ছাড়ের ভাষা নেই—তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন, কোনো পক্ষকেই একচুল ছাড় দেবেন না।

রাজস্ব বিভাগে বিদ্রোহ, কাস্টমস ও প্রশাসনিক স্তরে অসন্তোষ

সরকার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) পুনর্গঠন করার পরপরই এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা একযোগে ধর্মঘটে নেমেছেন। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কাস্টমস কর্মকর্তারাও একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। বেসামরিক কর্মচারীরা “দায়িত্বে স্বচ্ছতা” নিশ্চিত করতে নতুন আইন পুনর্বহালের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নেমেছেন। সচিবালয়ে স্লোগানে স্লোগানে মুখর সরকারি কর্মচারীরা কার্যত অচল করে তুলেছেন প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু।

এনবিআর ও সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনের জবাবে এনসিপি (NCP) নেতারা পাল্টা হুমকি দিয়েছেন, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

অবনত অর্থনীতি ও বিনিয়োগ স্থবিরতা

বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন প্রবল চাপে। ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা নেই, নতুন কোনো বিনিয়োগ দৃশ্যমান নয়। দেশের নানা প্রান্তে সিটি করপোরেশনের গেইটে ঝুলছে তালা, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি চালাচ্ছে কর্মসূচি। প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয় যেন প্রতিবাদের ঘাঁটি হয়ে উঠেছে।

পাশাপাশি রাজনৈতিক ময়দানে উত্তেজনার পারদ চড়ছে। বিএনপি (BNP) আগামী ২৮ মে ‘তারুণ্যের সমাবেশ’-এ ১৫ লাখ মানুষের জমায়েতের ঘোষণা দিয়েছে। এটা নিছক একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি নয়, বরং সরকারবিরোধী বড় ধরনের চাপ তৈরির অংশ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

সেনাবাহিনীর অবস্থান ও সরকারি বার্তা

এরই মাঝে আইএসপিআরের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, সেনাবাহিনী ও অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। বরং রাষ্ট্রের স্বার্থে উভয়পক্ষ একসঙ্গে কাজ করছে বলে দাবি করা হয়েছে। তবে বেসামরিক কর্মচারীদের বিক্ষোভ, রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয়তা এবং প্রশাসনিক অচলাবস্থার মধ্যে এই বার্তা কতটা আশ্বস্তকারী, সে নিয়ে জনমনে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

সংলাপের আড়ালে নেপথ্য দ্বন্দ্ব

প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক হলেও সেই সংলাপ ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে বিভ্রান্তি। দলগুলো যেখানে সংস্কারের পর নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে নির্বাচনের পক্ষে মত দিয়েছে, সেখানে প্রচার হচ্ছে যেন সবাই এককাট্টা। বাস্তবতা হলো, বেশিরভাগ দল ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন চায়।

সূত্র বলছে, নির্বাচনের সময়সূচি বিলম্বিত হচ্ছে শুধুমাত্র এনসিপি ও ছাত্র সমন্বয়কারী সংগঠনগুলোকে সংগঠিত হতে সময় দেওয়ার জন্য। মূলত, নির্বাচন নয়, বরং নেপথ্য প্রস্তুতিই প্রধান লক্ষ্য। যদিও তারেক রহমানের পরিচ্ছন্ন কর্মসূচি এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বক্তব্য রাজনৈতিক মাঠের গতিপথ বদলে দিতে পারে।

ড. আলী রীয়াজের মতে, নির্বাচন ও সংস্কার একে অপরের পরিপূরক। কোনো বিরোধ নেই—বরং দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত নিরাপত্তার দিকেই নজর দিতে হবে যাতে ভবিষ্যতে স্বৈরাচার মাথাচাড়া দিয়ে না ওঠে।

শেষ প্রশ্ন: কোথায় যাচ্ছে সবকিছু?

এই মুহূর্তে রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, যেখানে ভবিষ্যত এক ধোঁয়াশায় মোড়া। পরিস্থিতি হয়তো পুরোপুরি জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে, নয়তো ইউনূস—ক্লান্ত, কোণঠাসা, কিন্তু অনড়—জনতার সহানুভূতি কুড়িয়ে শেষ পর্যন্ত একটি নৈতিক প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে উঠবেন।

প্রবাদে যেমন বলা হয়, ‘বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়’—প্রধান উপদেষ্টার চেয়ে তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীরাই এখন বেশি দৃশ্যমান, বেশি সরব। এই অবস্থায়, সংলাপের নাটকীয়তা ও মাঠের উত্তেজনা মিলে আগামী দিনে রাজনৈতিক অভিমুখ কোথায় যাবে, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *