মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদানের ভিত্তিতে মুজিবনগর সরকারের নেতাদের ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ এবং সহায়ক ভূমিকায় থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিল্পীদের ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত এই শ্রেণিবিন্যাসেশেখ মুজিবুর রহমান (Sheikh Mujibur Rahman) ও জাতীয় চার নেতা স্বীকৃতি পেয়েছেন সর্বোচ্চ শ্রেণিতে।
মঙ্গলবার রাতে আইন মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারিকৃত সংশোধিত জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) অধ্যাদেশে এই সিদ্ধান্তের কথা বলা হয়। মুজিবনগর সরকারের সদস্যদের ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃতি ও কর্মচারীদের ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম (Faruk E Azam)। তিনি বলেন, “সংজ্ঞা পরিবর্তন হলেও কারও সনদ বাতিল করা হয়নি, কেবল ভূমিকার উপর ভিত্তি করে শ্রেণিবিন্যাস করা হয়েছে।”
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার শপথ নেয়। শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হলেও কারাগারে থাকায় ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী হন, মন্ত্রিপরিষদে ছিলেন এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামান এবং খন্দকার মোশতাক আহমদ।
এই সরকারের সদস্যরা এখন থেকে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও, তাদের সহকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী, চিকিৎসক, নার্স, সাংবাদিক, বিদেশে জনমত গঠনে নিয়োজিত ব্যক্তিরা ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে গণ্য হবেন।
মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় দেখা গেছে, অনেক কর্মচারী আগে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে বিবেচিত হলেও নতুন সংজ্ঞা অনুযায়ী তারা এখন ‘সহযোগী’ পর্যায়ে পড়বেন।
এ নিয়ে কিছু বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়ায় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী (Mostofa Sarwar Farooki) তার ফেসবুক পেজে স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, “জাতীয় নেতাদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল হয়নি, এটি একটি ‘ফেইক নিউজ’।” তিনি অধ্যাদেশের স্ক্রিনশটও প্রকাশ করেন।
নতুন অধ্যাদেশে ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে যাদের শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে, তাদের পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে:
১. বিদেশে মুক্তিযুদ্ধপন্থী জনমত গঠন ও কূটনৈতিক ভূমিকা পালনকারী পেশাজীবীরা।
২. মুজিবনগর সরকারের অধীন নিয়োজিত কর্মচারী, চিকিৎসক ও সহকারী কর্মীরা।
৩. ১৯৭১ সালের এমএনএ ও এমপিএগণ, যারা পরে গণপরিষদের সদস্য হন।
৪. স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী-কলাকুশলী এবং দেশি-বিদেশি সাংবাদিক।
৫. স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্যরা।
একসময় ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে বিবেচিত স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের (Swadhin Bangla Football Team) সদস্যরা—যেমন মোহাম্মদ জাকারিয়া পিন্টু, কাজী সালাহউদ্দিন, এনায়েতুর রহমান খান—এখন থেকে ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে বিবেচিত হবেন।
নতুন সংজ্ঞা অনুসারে, কেবলমাত্র ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত যারা সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের প্রশিক্ষণ শিবিরে যুক্ত হয়েছেন এবং যুদ্ধ করেছেন, সেই সব বেসামরিক নাগরিক, সশস্ত্র বাহিনী, ইপিআর, পুলিশ, মুক্তিবাহিনী, নৌ কমান্ডো, কিলো ফোর্স ও আনসার সদস্যরাই ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন।
ফারুক ই আজম স্পষ্ট করে বলেন, “কারও কোনো সুবিধা বাতিল হয়নি। কেবল ভূমিকার স্পষ্টতা আনার জন্য শ্রেণিভেদ করা হয়েছে।” এই উদ্যোগের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আরও সুনির্দিষ্ট ও প্রামাণ্য ভিত্তিতে সংরক্ষিত হবে বলেই আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।