বাংলাদেশে ইসলামী দল ১২-১৫ শতাংশ ভোট পায়, ভবিষ্যতেও জামায়াত প্রান্তিক দল হিসাবেই থাকবে: একান্ত সাক্ষাতকারে মাহফুজ

বাংলাদেশে ইতিহাস বইয়ে যুক্ত হয়েছে এক নতুন অধ্যায়—১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের জুলাই মাসের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পর্যন্ত বড় রাজনৈতিক ঘটনাগুলো এখন থেকে থাকবে পাঠ্যসূচিতে। এই পরিবর্তনের পেছনে যিনি অন্যতম মস্তিষ্ক, তিনি হলেন মাহফুজ আলম (Mahfuj Alam), বাংলাদেশের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা। ২৮ বছর বয়সী মাহফুজ, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারকে বিদায়ে বাধ্য করা ছাত্র-আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক হিসেবে পরিচিত।

তিনি বিশ্বাস করেন, সাহিত্য, ইতিহাস, সিনেমা এবং অ্যাকটিভিজম এমন কিছু হাতিয়ার যা আদর্শগত বিভাজনের উর্ধ্বে গিয়ে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে। “আমি বহুদিন ধরেই সমাজের নানা অংশের সঙ্গে সম্পর্ক রাখছি। এই কারণে আন্দোলন কবে, কোথায়, কীভাবে হবে—এসব কৌশল নির্ধারণে আমি ভূমিকা রাখতে পেরেছি,” বলেন তিনি।

সামনের পথচলা নিয়ে আশাবাদী হলেও সতর্ক মাহফুজ। দি উইকে প্রকাশিত মাহফুজ আলমের সাক্ষাতকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ:

প্রশ্ন: বাংলাদেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা মোকাবেলায় আপনি কীভাবে কাজ করছেন?
**মাহফুজ আলম অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনুস (Professor Mohammad Yunus) ঈদের আগের রাতে সাধারণ নির্বাচনের সময়সূচি (এপ্রিল ২০২৬) ঘোষণা করার পর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা থাকার কথা না। কিন্তু বিএনপি এখনো দাবি করছে নির্বাচন ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে হোক। তাদের মিত্র দলগুলো পরীক্ষার তারিখ থেকে শুরু করে আবহাওয়া পর্যন্ত নানা অজুহাত দিচ্ছে। এই বিতর্ক কিছুদিন চলবে এবং যারা অনিশ্চয়তা জিইয়ে রাখতে চায় তারা ইউনুস স্যারের বিরুদ্ধে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার অভিযোগ তোলাই থাকবে। তবে আমরা অপেক্ষা করছি কনসেনসাস কমিশনের রিপোর্টের, যারা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শ করে জুলাই চার্টার প্রকাশ করবে। এরপরই স্থিতিশীলতা আসবে এবং নির্বাচনকেন্দ্রিক কাজ শুরু হবে।

প্রশ্ন: আপনি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের বিষয়ে কী ভাবছেন?
মাহফুজ আলম: অন্তর্ভুক্তিমূলক বলতে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ বুঝি না। গত ১৫ বছরে কর্তৃত্ববাদী মানসিকতার দলগুলোই গণতন্ত্রের ক্ষতি করেছে। তারা যদি নির্বাচনে অংশ নেয়, তবে জনগণের প্রতিরোধের মুখে পড়বে। আওয়ামী লীগ (Awami League) নিষিদ্ধ, তাই তারা সম্ভবত অংশ নেবে না। অন্যদিকে, জুলাই অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া তরুণ-তরুণীরা ভোট দিতে চায়। আমাদের প্রজন্ম গত ১৫ বছর ভোট দিতে পারেনি, এবার দেবে। এই নির্বাচন হবে অনেক বেশি যুবকেন্দ্রিক, নারীদের অংশগ্রহণেও হবে বাস্তবিক অন্তর্ভুক্তিমূলক।

প্রশ্ন: নতুন রাজনৈতিক ক্ষেত্র গঠিত হচ্ছে—কীভাবে নিশ্চিত করবেন এটি পুরনো কাঠামো পুনরাবৃত্তি করবে না?
মাহফুজ আলম: এটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে প্রতিটি বিপ্লব থেকেই কিছু নতুন জন্ম নেয়। আলজেরিয়ানরা বলত “নতুন মানুষ”—বয়সে নয়, নৈতিক ভিত্তি ও দৃষ্টিভঙ্গিতে। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের প্রজন্মই হতে পারে সেই নতুন শক্তি। আমরা ইতিমধ্যেই দেখিয়েছি—আমরা প্রচলিত রাজনীতির ধারায় ফিরতে চাই না। আমাদের আন্দোলন ক্ষমতা বা পদ পাওয়ার জন্য নয়, বরং ন্যায়, সুবিচার ও মর্যাদার জন্য ছিল। তবে সতর্ক থাকতে হবে—ক্ষমতা দুর্নীতিগ্রস্ত করে। স্বচ্ছতা, নেতৃত্বের আবর্তন, অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র এবং মানুষের কথায় কান দেওয়াই হতে হবে আমাদের মূল ভিত্তি।

প্রশ্ন: রাজনৈতিক ইসলাম এবং জামায়াতে ইসলামীর ভবিষ্যৎ ভূমিকা সম্পর্কে আপনার অবস্থান কী?
মাহফুজ আলম: বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইসলামের একটা সীমা আছে। ঐতিহাসিকভাবে তারা কখনোই ১২–১৫ শতাংশের বেশি ভোট পায়নি। জামায়াত ভবিষ্যতেও প্রান্তিক শক্তি হিসেবেই থাকবে। তাছাড়া, বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক ইসলাম পরিবর্তিত হয়েছে। আমরা এখন পোস্ট-ইসলামিজম যুগে আছি, যেখানে ইসলামপন্থী দলগুলোও নিজেদের আদর্শ পুনর্বিবেচনা করছে। বাংলাদেশ ব্যতিক্রম নয়। ১৯৭১ সালের যুক্তি এখন আর চলে না। আমি স্পষ্ট করে বলছি, রাষ্ট্রকে অবশ্যই ধর্মনিরপেক্ষ হতে হবে। তবে এই ধর্মনিরপেক্ষতা যেন গ্রামীণ বা ঐতিহ্যবাহী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অস্ত্র না হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের দরকার এক অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র—যা ইসলামপন্থী নয়, ধর্মবিরোধীও নয়, বরং সবার প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

প্রশ্ন: ছাত্র প্রতিনিধিরা বর্তমানে কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি?
মাহফুজ আলম: আমরা চেয়েছিলাম একটা পূর্ণাঙ্গ কাঠামোগত পরিবর্তন—নতুন আইন, নির্বাচনী সংস্কার, স্বাধীন নজরদারি। এখনো তা হয়নি। আর একটা ভারসাম্যহীনতা রয়ে গেছে। আমাদের প্রজন্ম যারা অভ্যুত্থান করেছিল, তারা এখনো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে খুবই দুর্বল—প্রশাসন, বিচার বিভাগ বা সেনাবাহিনীতে তাদের বন্ধু নেই। ব্যবসা-বাণিজ্যের জগতে তাদের কোনো অবস্থান নেই। বিএনপি সেই প্রভাব রাখে, জামায়াত বা আওয়ামী লীগও তাই।

তবুও, তরুণরাই বাংলাদেশের নতুন মুখ। দীর্ঘমেয়াদে এটাই গুরুত্বপূর্ণ হবে। তাই আমরা অংশগ্রহণ করব, কিন্তু ভারসাম্যহীনতা এখনো রয়ে গেছে। এটা সেই কাঙ্ক্ষিত নতুন বাস্তবতা নয়, তবে আমরা জানি পরিবর্তন সময় নেয়।

প্রশ্ন: তাহলে কি ভবিষ্যতে আবার অস্থিরতা দেখা দিতে পারে?
মাহফুজ আলম: সবসময় এমনটা হবে না। এটা নির্ভর করছে প্রক্রিয়াটা কতটা অন্তর্ভুক্তিমূলক হয় তার উপর। এখন জাতীয় ঐক্যের সময়, আরেকটা সহিংসতার নয়। যদি রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রের স্টেকহোল্ডাররা জনগণের কণ্ঠস্বর শোনে—বাস্তবিকভাবে শোনে—তাহলে শান্তিপূর্ণ রূপান্তর সম্ভব। না শুনলে, আর যদি বাদ দেওয়ার সংস্কৃতি চলতেই থাকে, তাহলে ইতিহাস বলে দেয়—রাস্তায় হতাশা ফিরে আসবে।

প্রশ্ন: ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে আপনার মতামত কী?
মাহফুজ আলম: আমি পরিষ্কারভাবে বলছি—আমরা ভারতের প্রতি উন্মুক্ত। বরং ভারতের নাগরিক সমাজ ইতোমধ্যেই সমর্থন জানিয়েছে, বিশেষ করে কলকাতার ছাত্র গোষ্ঠীগুলো। কারফিউ চলাকালীন ওরা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে—এটা আমাদের জন্য অনেক বড় কথা। তবে শুধু প্রতীকী সমর্থন নয়, এর বাইরেও কিছু প্রয়োজন। ভারতীয় সরকার ও মিডিয়াকে শুধু আওয়ামী লীগকেন্দ্রিক চিন্তা না করে, আমাদের অন্যান্য কণ্ঠও শুনতে হবে। বাংলাদেশ একক বৈচিত্র্যহীন কোনো দেশ নয়—অনেক কণ্ঠ, অনেক প্রবাহ এখানে আছে। ভারত যেন আমাদের শুধুই “ইসলামপন্থার ভয়” বা “অস্থিরতার আতঙ্ক” দিয়ে না দেখে। আমাদের পথ আলাদা। আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা এখনো জীবিত—ক্ষতবিক্ষত হলেও।

প্রশ্ন: নতুন এই প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কীভাবে দেখেন?
মাহফুজ আলম: বাংলাদেশের স্বাধীনভাবে সব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার অধিকার আছে। যতক্ষণ না সেই সম্পর্ক আমাদের সার্বভৌমত্ব বা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, ততক্ষণ কোনো সমস্যা নেই। ভারত ও বাংলাদেশ দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র—দীর্ঘ ইতিহাস ও জনগণের পারস্পরিক বন্ধন রয়েছে। ভারত যেন আমাদের ইসলামী আতঙ্কের চশমা দিয়ে না দেখে। আমরা আরেকটা পাকিস্তান নই।

প্রশ্ন: অন্তর্বর্তী সরকারে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে আপনি দ্বৈত স্বার্থের অভিযোগের মুখে পড়ছেন—আপনার জবাব কী?
মাহফুজ আলম: এটা বিএনপি ও তাদের মিত্রদের অপপ্রচার। জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব ছিল ছাত্রদেরই। তারা পুরো সরকার দখল করে ক্ষমতা নিতে চায়নি। বরং তারা অধ্যাপক ইউনুসকে সামনে রেখে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে সাহায্য করেছে, যেখানে সমাজের বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। ছাত্র প্রতিনিধিরা এই সরকারকে বৈধতা দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তাদের নিজস্ব মন্ত্রণালয় ও প্রতিশ্রুতি আছে, কিন্তু তারা কোনোভাবে ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টিকে (NCP) সহায়তা করছে না। বরং বিএনপি, জামায়াত এবং অন্যান্যদের প্রভাব যদি NCP-এর চেয়েও বেশি হয়, তাহলে এই অভিযোগ প্রমাণ করে—এসবই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং পক্ষপাতদুষ্ট।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *