কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী জুলকারনাইন সায়ের খান, তার মা-বাবা ও পরিবারকে নিয়ে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কটূক্তির অভিযোগ উঠেছে এনসিপির ছাত্র সংগঠন বাগছাসের নেতা ফারদিন হাসানের নামে । বিষয়টি নিয়ে জুলকারনাইন সায়ের নিজেই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। পাশাপাশি, সায়ের ও তার পরিবারকে নিয়ে নোংরামি, সীমালঙ্ঘন ও চিন্তাগত দেউলিয়াত্বের অভিযোগ তুলে এর তীব্র নিন্দা প্রতিবাদ জানিয়েছেন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি আবু সাদিক কায়েম।
আজ বুধবার (২৫ জুন) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এক পোস্টে সাদিক কায়েম লেখেন, প্রতিটি মানুষের রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক আদর্শ ও দর্শন আছে। একজনের সাথে আরেকজনের ভিন্নতা থাকাটাও সৌন্দর্য। সেই জায়গায় অন্য কারো বিরোধিতা করারও কিছু বেসিক গ্রামার ও নৈতিকতা থাকে। এখানে ব্যক্তির সম্মানিত মা-বাবা, পরিবারকে হেয় প্রতিপন্ন করা সীমালঙ্ঘন ও চিন্তাগত দেউলিয়াত্বের পরিচয়।
তিনি আরও লেখেন, জুলাইয়ে আমাদের বৃহৎ কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে সায়ের ভাইয়ের সাথে পরিচয় হয়। ওনি ওনার জায়গা থেকে সর্বোচ্চ কোওপারেট করেছেন ও ভবিষ্যতে করবেন বলে আশাবাদী। সায়ের ভাইয়ের পরিবার তথা মা-বাবাকে নিয়ে যে নোংরামি হচ্ছে সেটার প্রতিবাদ জানাই। আল্লাহ আমাদের বুঝ দিক।
এর আগে, সম্প্রতি ফেসবুকে এনসিপির ছাত্র সংগঠন বাগছাসের নেতা ফারদিন হাসান সায়েরকে নিয়ে লেখেন, জুলকারনাইন সায়েরের বাবার বিয়ে ছিল দুইটা। প্রথম ঘরের সন্তান হিসেবে সায়ের সবসময় কিছুটা অবহেলিত ছিল। তাছাড়া শুনেছি সায়েরকে নাকি তার বাবা ত্যাজ্য পর্যন্ত করে একসময়। পরবর্তীতে তার বাবার আরেক ঘরের বউ ডিওএইচএসে পাওয়া প্লটে বানানো ফ্ল্যাটের ভাগ না দিলে সায়ের যায় সাবেক জেনারেল আজিজের দ্বারে। আজিজের হস্তক্ষেপে দুই ঘরের লোকজন সমঝোতায় আসলে সায়ের থাকার জন্য মাথার উপর ছাদ পায়। এই ঘটনার পর থেকে বাবাহারা সায়েরের দায়িত্ব নেয় আজিজ, সায়ের নিজেও অনেকদিন পর বাবা খুঁজে পায়। বিদেশ সফর থেকে শুরু করে সবকিছুতে সায়েরকে নিয়েই যেতো সে। তাকে আগলে রাখতে শুরু করে একেবারে সন্তানের মতন। অথচ সায়ের আবারও নিজের নতুন বাবাকে হারায় সে বাবাকে ঐতিহাসিক এক কট দিয়ে। সে কটটার নাম ছিল ‘Prime Minister’s Men’। এই নিমকহারামীতে অবশ্য আমরা কিছুটা উপকৃত হই। কিন্তু সায়ের? সে আবার ফাদারলেস হয়ে যায়।
আরও পড়ুন: ইশরাকের ‘বুকে গুলি চালায় দেন’ বক্তব্যের জবাবে আসিফ— ‘একটা মাছিকেও কখনও গুলি করিনি’
তিনি লেখেন, নিজের প্রথম ও আদি বাবার বেলায় সায়ের নিজের বাবাকে এতটাই ভালোবাসতো যে চাঁদাবাজি করতে গেলেও বাপের ইউনিফর্ম পরে যাইতো। লোকটা স্যাডলি বেশিদিন বাঁচে নাই। আর এরপরে যারে বাবা বানাইলো তার ইউনিফর্মটাও বেশিদিন রাখতে দেয় নাই। সায়েরের এইবার নতুন আরেকটা বাবা হয়েছে। আমি নাম বলবো না কিন্তু আপনারা সবাই জানেন কমবেশি যে আমি কার কথা বলতেসি। এই লোকটার জন্য আমার মায়া হয়। আগের দুই লোকের পরিণতি এই লোকটারও হয় কিনা কে জানে? সায়েরের বাবার রেকর্ড তো বেশি একটা ভালো না।
এনসিপির ছাত্র সংগঠন বাগছাসের নেতা ফারদিন আরও লেখেন ফর্টি ইয়ার্স ইন সার্ভিসের বড় বন্ধুকে বলবো সাবধান, কপাল তোমাকে এমন একটা সন্তান দিয়ে গেছে যাকে তুমি পয়দাও করো নাই। কিন্তু সে আবার তোমার পয়দা করা বাচ্চাকাচ্চার জেনারেশনাল ট্রমায় না পরিণত হয় যাতে সেদিক খেয়াল রাইখো। আজিজের পোলা তো সায়ের ট্রমার পর মাঝ রাস্তায় গাড়ি টাড়ি উল্টায় পরে ছিলো। বড় বন্ধু তাই এমন কাউকে সন্তান বানাইয়ো না যার বাবাদের সাথে রেকর্ড ভালো না।
সায়েরকে হুমকি দিয়ে ফারদিন লেখেন, আর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট সায়ের, তুমি এত সৎ সাইজো না। সবাইরে এত শাসন কইরো না। তোমার ইতিহাস এলাকার মানুষ জানে। তাই এত ভং ধরার দরকার নাই যে তুমি খুব ভালো লোক। আর তাছাড়া খারাপ লোক হওয়াও সমস্যা না। খারাপ লোকও অনেক ভালো কাজ করে। কিন্তু এই মোরাল গেইম আর মাইনষের পাছায় কামড়াকামড়ি থামাও। দেশে ISPR আছে, তোমার আর্মির মাউথ পিস না হইলেও তো চলে। আগের মতন ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম করো পারলে, মানুষের আসলেই উপকার হবে।
অন্যদিকে, ফারদিনের ফেসবুক পোস্টের স্ক্রিনশট ফেসবুক পোস্টে শেয়ার করে তার উদ্দেশ্যে ক্যাপশনে জুলকারনাইন সায়ের খান লেখেন, এই পোস্টটা আজকেই প্রথম দেখলাম, একজন শুভাকাঙ্ক্ষী পাঠালেন। বেশ জটিল একটা কাজের মাঝে ছিলাম, কিন্তু পোস্টের শব্দচয়ন দেখে, উত্তর দেয়া প্রয়োজন বিধায় লিখছি। আমার আম্মু ১৯৯৬ সালে ভয়াবহ এক সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত হন। আম্মুর মৃত্যুর পর আমার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন, এবং সেটা আমার ও আমার ছোট ভাইয়ের অনুমতি নিয়ে। মুসলিম আইনে সন্তানকে ত্যাজ্য করার কোন বিধান আছে বলে আমার জানা নাই — তবে আপনার এই ন্যারেটিভের সাথে আওয়ামী আমলের বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক প্রচারিত অপপ্রচারের একটা অদ্ভুত মিল আছে। আমার দ্বিতীয় মা’র সাথে আমার সম্পর্ক বেশ ভালো, আমি তাঁকে মায়ের মর্যাদাই দিয়ে এসেছি, আমার বেড়ে ওঠার বিভিন্ন স্তরে তিনি যথাসাধ্য সহায়তাই প্রদান করেছেন। আপনার জ্ঞাতার্থে — আমার মৃত মা বহুগামী ছিলেন না — এবং আমার পিতাও একজন।
তিনি লেখেন, আমার মা বেশ সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন। চাঁদপুর জেলার বহুল পরিচিত নাম, ডা. আমিন আহমেদের কন্যা ছিলেন তিনি। আমার মরহুম নানা, ৫০ এর দশকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস সম্পন্ন করেন এবং ৫২’ এর ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর সম্পদের পরিমাণ এতটাই ছিলো যে চাঁদপুর শহরের হাজী মহসীন রোড (ছায়াবানী ও চিত্রলেখা সিনেমা হলের মধ্যবর্তী) সকল স্থাবর সম্পদ তাঁর বলে বিবেচনা করা হতো, এছাড়াও কলেজ রোড চাঁদপুর এবং রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় তাঁর যথেষ্ট সম্পত্তি ছিল, যা উত্তরাধিকার সূত্রে আমি ও আমার ভাই বুঝে পেয়েছি। এছাড়াও, আমার মরহুম বাবা, একজন চিকিৎসক ছিলেন এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্নেল পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা ছিলেন। চাঁদপুর শহরের রহমতপুর কলোনিতে গিয়ে একটু জিজ্ঞাসা করলেই আপনি আমার পৈতৃক সম্পদের বিষয়ে জানতে পারবেন। সুতরাং ডিওএইচএসে ফ্ল্যাটের জন্যে আমাকে কারো দ্বারস্থ হতে হবে, আপনার এমন ভাবনা বেশ সস্তা।
সায়ের লেখেন, আপনার জানা প্রয়োজন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে আমার জন্ম হয়, সেনাবাহিনীর মোটা চাল ও লাল আটার রুটি খেয়ে আমি বড় হয়েছি। সেনাবাহিনী পরিচালিত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেশ সেরা শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়েছি। সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে প্রশিক্ষণের জন্যে নিজ যোগ্যতায় বিবেচিত হয়েছি। নিজের ডানপিটে স্বভাবের জন্যে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি হতে বহিষ্কৃত হয়েছি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হাজারো কর্মকর্তা-লাথো সাধারণ সদস্য আমাকে চেনেন, এই বাহিনীতে কর্মরত রয়েছেন আমার শতশত বন্ধু – শুভানুধ্যায়ী। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একটা বৃহৎ পরিবারের মতো। কিন্তু এই পরিবারের কিছু সদস্য যখন বাহিনীর কষ্টার্জিত সুনাম এবং সম্মানের মুখে কালিমা লেপন করছিলো, তখন বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আত্নমর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে নিজ নিরাপত্তা বিপন্ন করে আমি কর্মরত একজন সেনাপ্রধানের সকল অপকর্মের খতিয়ান প্রকাশ করি। আমাকে এটা করতে উদ্বুদ্ধ করেছে, কেবল একটি লাইন — চির উন্নত মম শির।
তিনি আরও লেখেন, অল দ্যা প্রাইম মিনিস্টারম্যানের পর, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী ও তাদের অপকর্ম ঘিরে যত প্রতিবেদন হয়েছে, তার কমপক্ষে ৮৫% এর সাথে আমার সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিল। আমি জানি না আপনি বা আপনারা তখন কি করছিলেন। কিন্তু আমি নিজ জীবনের নিরাপত্তা বিপন্ন করে হলেও, একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে আমার কাজটা করে গিয়েছি, খেসারত হিসেবে আমার ভাইকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে তার বিভিন্ন মাংসপেশি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়, যার রেশ আমার নিরীহ ভাই এখনো পর্যন্ত বহন করে চলেছে।
অভিযুক্ত ফারদিনকে উদ্দেশ্য করে জুলকারনাইন সায়ের ফেসবুক পোস্টে আরও বলেন, আমার সমস্যা কি জানেন ফারদিন? আমি আমার জন্মভূমিকে প্রচণ্ড ভালোবাসি, এবং যারাই এই মাটির স্বার্থ বিরোধী কিছু করবে, আমার দেশের সাধারণ জনগণের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলবে, তাঁদের উপযুক্ত স্থানে পৌঁছে দিতে আমি বদ্ধ পরিকর। আমার হারানোর কিছু নেই। ১৩ বছর বয়সে মাতৃহীন ও ২৩ বছর বয়সে পিতৃহীন হওয়ার পরেও সম্পূর্ণ নিজ যোগ্যতায় আজ আমি নিজের একটা পরিচয় তৈরি করতে পেরেছি। আমার মরহুম মা ও মরহুম বাবা এবং আমার পরিশ্রম ও সততার অসম্মান করার ধৃষ্টতা আপনি আর কখনো করবেন না, সেটাই কামনা করছি।
এদিকে এনসিপির ছাত্র সংগঠন বাগছাসের নেতা ফারদিন হাসানকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা কথা চাউর আছে, তার বিরুদ্ধে সমকামিতার অভিযোগ করে আসছে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের অনেকেই , এমনকি খোদ তার ফারদীন ফেসবুক প্রোফাইলে সমকামিতা নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা করতে দেখা গিয়েছে, সেইসব স্ক্রিনশট এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে ফেসবুকের ওয়ালে ওয়ালে ।



