পিআর পদ্ধতির নির্বাচন নয়া বিতর্ক : ‘ভারতীয় এজেন্ডা’ না ‘ক্ষমতা বাঁচানোর ছলনা’?

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে ‘সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব’ বা পিআর পদ্ধতির নির্বাচন। অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে একদিকে যখন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে, অন্যদিকে কিছু রাজনৈতিক দল হঠাৎ করেই এই নতুন ও অচেনা পদ্ধতির পক্ষে জোরালো সুর তুলেছে। এতে সামাজিক মাধ্যমে তৈরি হয়েছে তীব্র বিতর্ক—এটি কি ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়নের কৌশল? নাকি সংসদে নিজ নিজ দলকে প্রভাবশালী করে তুলতে ক্ষমতা কৌশলের অংশ?

সরকার গঠনের পর থেকেই নির্বাচন ঘিরে প্রশ্ন উঠছে। নির্বাচন হলে অন্তর্বর্তী সরকারের গুরুত্ব কমে যাবে—এমন শঙ্কায় কিছু মহল শুরুতে নির্বাচন বিলম্বে চেয়েছিল। কিন্তু ঐতিহাসিক লন্ডন বৈঠক ও রমজানের আগেই নির্বাচনের বার্তা আসায় দেশের ১২ কোটি ভোটার এখন ভোট দিতে মুখিয়ে। নির্বাচন কমিশনও প্রস্তুতি শুরু করেছে। মূলধারার ধারণা ছিল, কিছু সংস্কারের পর প্রচলিত পদ্ধতিতেই নির্বাচন হবে।

তবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাম্প্রতিক বৈঠকগুলোতে হঠাৎ করে উঠে এসেছে পিআর পদ্ধতির প্রস্তাব। দীর্ঘ ১৫ বছর পর ভোট দেওয়ার সুযোগ পেতে যাওয়া নাগরিকদের কাছে এ পদ্ধতি নতুন এবং অনেকের কাছে অস্বস্তিকর। এর পেছনে ভারতের প্রভাব থাকার সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সচেতন নাগরিকদের মাঝে। কেউ বলছেন, এর মাধ্যমে ভারতে সমর্থিত দলগুলোকে, বিশেষ করে নিষিদ্ধ হওয়া আওয়ামী লীগ (Awami League)-কে সংসদে প্রবেশের পথ করে দিতেই পিআর পদ্ধতির নির্বাচন চালু করার পরিকল্পনা।

১৯৯১ সালের পর থেকে সংসদে উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধিত্ব ছিল না এমন দলগুলো এখন পিআর পদ্ধতিকে সামনে নিয়ে এসেছে। এদের পক্ষে এখন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনও সময় ব্যয় করছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পিআর পদ্ধতি বাস্তবায়িত হলে, আওয়ামী লীগ তাদের ৩০-৩৫% মূলভিত্তিক ভোটে সহজেই শতাধিক আসন পাবে। একইভাবে বিএনপি ৩৫-৪০% ভোট পেলেও ছোট দলগুলোর যোগফলে আওয়ামী লীগ গোপনে লাভবান হতে পারে। নেটিজেনরা বলছেন, যারা ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চায়, তারাই পিআর ইস্যুতে বেশি সক্রিয়।

বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন (Bangladesh Khelafat Andolon)-এর মহাসচিব মুফতি ফখরুল ইসলাম এই প্রস্তাবকে সরাসরি “ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এবং ইসরায়েলি মোসাদ-এর চক্রান্ত” বলে অভিহিত করেছেন। তিনি একে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন। হুঁশিয়ারি দিয়েছেন—এ ধরনের পদ্ধতি চাপিয়ে দিলে জনগণ রাস্তায় নামতে বাধ্য হবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান স্পষ্ট করে বলেন, “যাদের নিজেদের রাজনৈতিক ভিত্তি নেই, তারাই এখন পিআর দাবি তুলছেন। ইসলামী আন্দোলনের সমাবেশে জামায়াত, এনসিপি, এবি পার্টি, হিন্দু ও খ্রিস্টান নেতারা একক কণ্ঠে পিআরের পক্ষে স্লোগান দিচ্ছেন।” অথচ ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে জামায়াতের দীর্ঘদিনের বৈরিতা এবং আওয়ামী সরকারের ছায়ায় তাদের বাড়ন্ত ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সাম্প্রতিক মহাসমাবেশ থেকেই এই পিআর দাবির জোরালো উত্থান শুরু হয়। এখানে উপস্থিত ছিলেন বোধিজ্ঞান ভাবনাকেন্দ্র-এর সভাপতি দয়াল কুমার বড়ুয়া, বাংলাদেশ খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশন-এর সভাপতি নির্মল রোজারিও ও হিন্দু মহাজোট-এর মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক। প্রামাণিক বলেন, “পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে হিন্দুরা ভোটকেন্দ্রে যাবে না।” তাদের বক্তব্যকে ‘দিল্লির এজেন্ডা’ বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

ইসলামী আন্দোলনের (Islami Andolon)-এর আমির চরমোনাই পীর সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেন, “সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি ছাড়া সংসদে জালেমদের প্রবেশ বন্ধ করা যাবে না।” কিন্তু তার বক্তব্য ঘিরেই শুরু হয় আরও সমালোচনা—জামায়াতবিরোধী অবস্থান থেকে হঠাৎ জামায়াতঘেঁষা সুরে কথা বলার কারণ কী?

ইসলামী ঐক্য আন্দোলন-এর আমির ড. ঈশা সাহেদী বলেন, “পিআর পদ্ধতি নিয়ে আমরাও পরিষ্কার না, সাধারণ জনগণও বুঝে না। এটি বিদেশি রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া এজেন্ডা।” তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, এ পদ্ধতি বাস্তবায়িত হলে তেলবাজ এবং দলের কৌশলী নেতারাই এমপি হবেন, যোগ্য ব্যক্তি নয়।

গত তিন দশকের ভোটের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ভোটের ব্যবধান কখনোই ১০%-এর বেশি নয়। তবু বিভিন্ন সময় জামায়াতের মতো দলগুলো বিএনপির ছায়ায় গড়ে ১০টি আসন পেলেও তাদের নিজস্ব ভোটভিত্তি সব সময়ই ৫% এর নিচে। অথচ আজ সেই দলগুলো সংসদীয় কাঠামো পাল্টে দেওয়ার দাবিতে সোচ্চার, আর জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সেটি গুরুত্ব দিয়ে ভাবছে।

বিএনপি (BNP)-র স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “বাংলাদেশে পিআর পদ্ধতির কোনো ইতিহাস নেই। এতে ভোটার জানবে না কে তাদের প্রতিনিধি। ভোটাধিকার পুরোপুরি নেতাদের হাতে চলে যাবে।” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন যোগ করেন, “দলীয় মনোনয়ন এখনো কেনাবেচা হয়। পিআর চালু হলে সংসদীয় সিটও বিক্রি হবে।”

জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম-এর সিনিয়র সহসভাপতি আল্লামা আব্দুর রব ইউসুফী বলেন, “এটি ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের প্রচেষ্টা। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের অর্জন ধ্বংস করতেই এ কৌশল।”

সার্বিকভাবে, নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে এবং নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে উপকৃত করতে একটি নতুন পদ্ধতির অনধিকার চর্চা শুরু হয়েছে বলে মনে করছেন অধিকাংশ রাজনৈতিক বিশ্লেষক। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন কতটা গ্রহণযোগ্য—সেটি এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *