জনবহুল উত্তরায় বিমান বিধ্বস্ত: প্রশিক্ষণ ফ্লাইট কেন ঘনবসতিতে?

রাজধানীর উত্তরা দিয়াবাড়ীর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে সোমবার (২১ জুলাই) দুপুরে ঘটে গেল এক হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনা। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান আকাশ থেকে ছিটকে এসে আছড়ে পড়ে স্কুল ভবনে। মুহূর্তের মধ্যে বিকট বিস্ফোরণ, আগুনের ফুলকি ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে পুরো এলাকায়। দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও বিমানটির পাইলট।

ঘটনার পরপরই সোশ্যাল মিডিয়া ও জনমনে প্রশ্ন—কেন এত জনবহুল এলাকায় প্রশিক্ষণ বিমান ওড়ানো হচ্ছে? দুর্ঘটনাটি কেবল কাকতালীয়, না এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা? আন্তর্জাতিকভাবে কি জনবহুল এলাকায় এমন প্রশিক্ষণের অনুমোদন আছে?

প্রশিক্ষণ বিমান ও জনবসতি: প্রশ্ন উঠছে নিরাপত্তা নিয়ে

সাবেক এয়ার কমোডর ইসফাক ইলাহী চৌধুরী (Isfaq Ilahi Choudhury) জানান, “প্রশিক্ষণ কখনোই জনবসতিপূর্ণ এলাকায় হয় না।” তবে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকেই যেহেতু বিমানগুলো উড্ডয়ন ও অবতরণ করে, এড়ানো সম্ভব হয় না জনবহুল এলাকা। তিনি বলেন, মধুপুর, ময়মনসিংহ, ঘাটাইলের আকাশে প্রশিক্ষণ ফ্লাইট পরিচালিত হয়, কিন্তু রানওয়ে হিসেবে ঢাকাই ব্যবহার করতে হয়।

এই দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেও প্রশিক্ষণ চলছিল না বলে দাবি তার। উড্ডয়নের পর পাইলট ফিরছিলেন, আর অবতরণের মুহূর্তেই ঘটে যায় দুর্ঘটনাটি।

অবকাঠামোগত সংকট ও নিরাপত্তাহীনতা

কাজী ওয়াহিদুল আলম (Kazi Wahidul Alam), একজন বেসরকারি এভিয়েশন বিশ্লেষক, পরিস্থিতিকে আরো গভীরভাবে ব্যাখ্যা করে বলেন, “এখানে শুধু প্রশিক্ষণ বিমান নয়, যেকোনো ধরণের উড়োজাহাজই এ এলাকায় বিপজ্জনক।” শাহজালাল বিমানবন্দরের আশপাশের অঞ্চলগুলো বর্তমানে অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় যেকোনো দুর্ঘটনা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।

তিনি মনে করেন, নতুন বিমানবন্দর স্থাপন ছাড়া এ সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। একসময় নতুন সাইটের পরিকল্পনা থাকলেও রাজনৈতিক ও স্থানীয় বিরোধে তা থেমে যায়। “রাষ্ট্রীয় স্বার্থে একটি আধুনিক ও নিরাপদ লোকেশনে বিমানবন্দর গড়ার বিকল্প নেই,” মন্তব্য তার।

পুরোনো বিমান, আধুনিক ব্যবহারে প্রশ্ন

আইএসপিআর জানিয়েছে, দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হওয়া বিমানটি একটি FT-7, যা মূলত একটি যুদ্ধবিমানের প্রশিক্ষণ সংস্করণ। এটির ভিত্তি রাশিয়ান মিগ-২১-এর চাইনিজ সংস্করণ F-7

১৯৬৬ সালে প্রথমবারের মতো এই মডেল আকাশে উড়েছিল। এটি দুই আসনের, যাতে প্রশিক্ষক ও শিক্ষানবিশ একসঙ্গে উড়তে পারেন।

ইসফাক ইলাহী চৌধুরীর মতে, “বিমানের মডেল পুরোনো হলেও, বর্তমান সংস্করণটি আধুনিকায়িত। ইঞ্জিন, এভিয়োনিকস—সবকিছুতেই উন্নয়ন হয়েছে। তবে বিশ্বে এখন ৪র্থ, ৫ম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান ব্যবহৃত হচ্ছে, সেখানে FT-7 এখন অনেকটাই পিছিয়ে।”

তবে ‘এফোর্ডেবিলিটি’ বা সামর্থ্যের কারণে বাংলাদেশ এখনো এই বিমানে নির্ভর করছে। যদিও দীর্ঘমেয়াদে চাইনিজ, রাশিয়ান কিংবা পশ্চিমা দেশগুলোর উন্নততর যুদ্ধবিমান কেনার পরিকল্পনা রয়েছে বলেই জানান তিনি।

দুর্ঘটনার কারণ: প্রযুক্তি, আবহাওয়া, না মানবিক ভুল?

এয়ারক্রাফট দুর্ঘটনার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে বলে জানান ইসফাক ইলাহী চৌধুরী। “মেশিন মেইন্টেন্যান্স, আবহাওয়া, হিউম্যান এরর, বার্ড হিট বা বিদ্যুৎ চমক—সবই সম্ভাব্য কারণ।”

তিনি বলেন, “যদিও বিমানে ওঠার আগে প্রতিটি অংশ নিয়মিত চেক করা হয়, তারপরও এমন দুর্ঘটনা এড়ানো যায় না সবসময়। এই ঘটনার প্রকৃত কারণ তদন্ত ছাড়া বলা যাবে না।”

অন্যদিকে, কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, “FT-7 বিমানগুলোর সেফটি স্ট্যান্ডার্ড আন্তর্জাতিক মানের নিচে। বহু দেশ এই মডেল ইতিমধ্যে ফেইজ-আউট করেছে। আমরাও সেটা বিবেচনায় আনতে পারি।”

জনসচেতনতা ও নীতিগত সিদ্ধান্ত এখন জরুরি

এই দুর্ঘটনা সামনে এনে দিয়েছে দীর্ঘদিনের এক অব্যবস্থাপনার চিত্র। রাজধানীর মাঝখানে একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, পুরোনো মডেলের প্রশিক্ষণ বিমান, ঘনবসতিতে উড্ডয়ন-পথ—সব মিলিয়ে এক বড় প্রশ্নচিহ্ন।

জনগণের জীবন ঝুঁকিতে রেখে আর কতকাল চলবে এই ব্যবস্থা? সময় এসেছে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নতুন করে চিন্তা করার, আধুনিকীকরণের পাশাপাশি জননিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *