বিতর্কিত রায়, ক্ষমতার সুবিধাভোগ ও শেষপর্যন্ত গ্রেপ্তার—সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের বিস্ময়কর যাত্রা

২০০৯ সালে হাইকোর্টের বিচারপতি থাকাকালে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক (ABM Khairul Haque) একটি চরম বিতর্কিত রায় দেন, যেখানে তিনি ঘোষণা করেন যে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (Sheikh Mujibur Rahman) স্বাধীনতার ঘোষক, জিয়াউর রহমান নন।’ তার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ সেই রায়ে সরকারকে নির্দেশ দেয়—‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ, দলিলপত্র’-এর তৃতীয় খণ্ড, যেখানে জিয়াউর রহমান (Ziaur Rahman)–কে ঘোষক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তা বাতিল করে দেশ-বিদেশ থেকে বাজেয়াপ্ত করতে। সেইসঙ্গে পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের ‘সঠিক ইতিহাস’ বাধ্যতামূলকভাবে যুক্ত করার নির্দেশও দিয়েছিলেন তিনি।

এই রায় রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবল আলোড়ন তোলে। রায়টি আওয়ামী লীগ সমর্থকদের কাছে প্রশংসিত হলেও বিরোধী পক্ষের জন্য ছিল গভীর বেদনার। একই সঙ্গে ইতিহাস ও সংবিধানের ব্যাখ্যা দিয়ে এমন একটি ঐতিহাসিক বিতর্ককে বিচার বিভাগের আওতায় আনার জন্য বিচারপতি খায়রুলের নিরপেক্ষতা নিয়েও তীব্র প্রশ্ন ওঠে।

খায়রুল হকের বিতর্কিত রায়ের তালিকা এখানেই থামে না। হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকদের আগাম জামিনের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া, ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা উচ্ছেদ করা এবং বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে (Khaleda Zia) ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের নেপথ্যে থাকা—এসবই তার আমলের সিদ্ধান্ত, যা পরে প্রবল রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়।

২০১০ সালে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান খায়রুল হক—অবশ্য সেটিও হয় কয়েকজন সিনিয়র বিচারপতিকে উপেক্ষা করে। এরপর ‘প্রধান বিচারপতির তহবিল’ থেকে নিজের চিকিৎসার জন্য অর্থ গ্রহণ এবং পরে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হওয়াও নতুন বিতর্ক তৈরি করে। বিশেষত, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এইসব সুবিধা গ্রহণ করায়, তার নিরপেক্ষতা নিয়ে সংশয় আরও ঘনীভূত হয়।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র ও জনতার আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। এরপর থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ একাধিক আমলা ও প্রভাবশালী ব্যক্তি। তখন থেকেই খায়রুল হকের অবস্থান ছিল অজানা। তিনি ১৩ আগস্ট আইন কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েন এবং গা-ঢাকা দেন। এরপর একাধিক মামলা দায়ের হয় তার বিরুদ্ধে, যার মধ্যে রয়েছে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য ইমরুল হাসানের করা একটি মামলা।

সবশেষে, বৃহস্পতিবার সকাল ৮টার দিকে রাজধানীর ধানমন্ডির বাসা থেকে সাবেক এই প্রধান বিচারপতিকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ডিবির যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম।

খায়রুল হকের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ ও বিতর্ক একাধিক স্তরে বিস্তৃত—সাংবিধানিক রায় থেকে শুরু করে রাজনৈতিক পক্ষপাত, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং সরকারি সুবিধা গ্রহণ। এখন দেখা যাক, তার বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া কীভাবে অগ্রসর হয়, আর সে প্রক্রিয়ায় দেশের বিচার বিভাগের অতীত বিতর্ক কীভাবে নতুন আলোয় প্রতিফলিত হয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *