শাহবাগ ঘিরে ফের সংঘবদ্ধ নিষিদ্ধ আ.লীগ-ছাত্রলীগ, সহিংস পরিকল্পনায় উত্তপ্ত রাজধানী

আন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ (Awami League) ও ছাত্রলীগ (Chhatra League) নতুন করে সংঘবদ্ধ হওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক সূত্র জানিয়েছে। দলীয় কার্যক্রমে প্রকাশ্যে না এলেও অনলাইনে সক্রিয়তা বাড়িয়ে সংগঠনের নেতাকর্মীরা ইতিমধ্যে রাজধানীমুখী সমাবেশ, সংঘাত ও বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণার ছক আঁকছে।

গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় সারাদেশ থেকে তৃণমূল নেতাকর্মীদের ঢাকায় জড়ো করা হচ্ছে। ‘ধানমন্ডি ৩২’, ‘ইউনূস হঠাও’, ‘প্রিয় স্বদেশ’, ‘এফ ৭১ গেরিলা’, ‘বঙ্গবন্ধু প্রজন্ম’সহ একাধিক গোপন অনলাইন গ্রুপে চলেছে রাষ্ট্রবিরোধী অপপ্রচার ও আতঙ্ক সৃষ্টির অপচেষ্টা।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (DMP) সিটিএসবির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, মফস্বলের বহু নেতাকর্মী রাজধানীতে আত্মগোপনে রয়েছেন এবং বিদেশে অবস্থানরত নেতাদের নির্দেশে দেশব্যাপী অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করছেন।

গোপন বৈঠক ও কলকাতা কানেকশন
৮ জুলাই বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার কে বি কনভেনশন সেন্টারে এক গোপন বৈঠকে অংশ নেয় ৩০০–৪০০ জন নেতাকর্মী। সিসিটিভি বন্ধ করে আয়োজিত ওই বৈঠকে শাহবাগ অবরোধ, সহিংস বিক্ষোভ এবং জনমনে আতঙ্ক তৈরির পরিকল্পনা হয়। বৈঠকে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাদের পাশাপাশি অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকটি আয়োজন ও তদারকির পেছনে ছিলেন মেজর সাদিকুল হক ওরফে মেজর সাদিক। গোয়েন্দা তথ্যে উঠে এসেছে, তিনি ও তার স্ত্রী সুমাইয়া জাফরিন কোনো অনুমতি ছাড়া ১৫০ দিন কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন এবং সেই সময় শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের (Sajeeb Wazed Joy) সঙ্গে যোগাযোগ রেখে নেতাকর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন।

এই পুরো পরিকল্পনার মূল তদারকিতে রয়েছেন কলকাতায় অবস্থানরত সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল (Asaduzzaman Khan Kamal)। তাকে সহযোগিতা করছেন সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, দিল্লি-নিবাসী পলাতক অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলাম এবং ডিজিএফআইয়ের সাবেক প্রধান মুজিবুর রহমান।

বসুন্ধরার ঘটনায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা
বসুন্ধরার বৈঠকের ঘটনায় ভাটারা থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করেছে পুলিশ। এখন পর্যন্ত অন্তত ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে আছেন যুবলীগ নেতা সোহেল রানা ও গোপালগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেত্রী শামীমা নাসরিন।

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তারা স্বীকার করেছেন যে, মেজর সাদিকের নির্দেশেই বিভিন্ন জায়গা থেকে নেতাকর্মীদের এনে রাজধানীতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। রাজধানীর অন্তত চারটি স্থানে প্রশিক্ষণের আয়োজন হয় বলে জানা গেছে, যেগুলোর ভিডিও প্রমাণ পরিকল্পিতভাবে মুছে ফেলা হয়েছে। মেজর সাদিক বর্তমানে সেনাবাহিনীর হেফাজতে রয়েছেন এবং দোষ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সেনা সদর থেকে জানানো হয়েছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে অনেকে ‘প্রিয় স্বদেশ’, ‘বঙ্গবন্ধু প্রজন্ম’, ‘এফ ৭১ গেরিলা’ নামের গোপন গ্রুপে সক্রিয় ছিলেন, যেখানে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র ও সহিংস পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হতো।

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও জনমনে উদ্বেগ
গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, “নিষিদ্ধ ঘোষণাটি যদি শুধু কাগজে-কলমে থাকে, তবে কোনো লাভ নেই। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা আত্মগোপনে থেকে হামলা চালাচ্ছে, অথচ প্রশাসনের কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেই।”

তিনজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজনৈতিক নেতা অভিযোগ করেন, সরকারের অতিরিক্ত নমনীয়তাই নিষিদ্ধ সংগঠনগুলোকে আবার সংঘবদ্ধ হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। যেসব নেতাকর্মী জুলাইয়ের আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় জড়িত ছিলেন, তাদের অনেকে এখনো প্রকাশ্যে চলাফেরা করছেন—কিন্তু কোনো বিচার কার্যক্রম শুরু হয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, “পুলিশ যেন কোনো দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার না হয়। বরং রাজনৈতিক আড়ালে যারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে নিরপেক্ষভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে।”

জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান ২৩ জুলাই এক ফেসবুক পোস্টে বলেন, “জুলাই-আগস্টের ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তিকে জাতীয় স্বার্থের জায়গায় যেকোনো মূল্যে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।”

বর্তমান পরিস্থিতিতে বিরোধী রাজনৈতিক জোট, নাগরিক সমাজ ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর প্রতি সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হচ্ছে, যেন রাষ্ট্রবিরোধী এই নাশকতা পরিকল্পনা রুখে দেওয়া যায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *