বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক কাঠামো নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার পর অবশেষে প্রকাশ্যে এলো জাতীয় ঐকমত্য কমিশন (National Consensus Commission) প্রণীত ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর চূড়ান্ত খসড়া। সেখানে উঠে এসেছে একাধিক যুগান্তকারী প্রস্তাব—প্রধানমন্ত্রী হলে কেউ আর দলীয় প্রধানের পদে থাকতে পারবেন না, একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না এবং সংসদ হবে দুই কক্ষ বিশিষ্ট।
সনদের খসড়ায় স্পষ্ট করা হয়েছে, এসব সুপারিশ এসেছে রাজনৈতিক দল, জোট ও নাগরিক শক্তির সম্মিলিত আলোচনার মাধ্যমে। তবে সব দল যে প্রতিটি প্রস্তাবে একমত, তা নয়; কয়েকটি সুপারিশে ভিন্নমতও জানিয়েছে কিছু দল।
গণতন্ত্র পুনর্গঠনের প্রেক্ষাপট
সনদের ভূমিকায় বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে প্রতিশ্রুত ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের’ রাষ্ট্রব্যবস্থা এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। গত দেড় দশকের শাসনব্যবস্থায় সংবিধান বিকৃত করা, নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস, প্রশাসন দলীয়করণ ও দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে বলে খসড়ায় অভিযোগ তোলা হয়। তবে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে গণআন্দোলনে কর্তৃত্ববাদী শাসক পতনের পর জনগণের মধ্যে রাষ্ট্রকাঠামো পুনর্গঠনের নতুন আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে।
রাষ্ট্রভাষা, নাগরিকত্ব ও সংবিধান
সনদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রভাষা থাকবে ‘বাংলা’, পাশাপাশি অন্যান্য মাতৃভাষা প্রচলিত ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। নাগরিক পরিচয় হবে ‘বাংলাদেশি’। সংবিধান সংশোধনে সংসদের দুই কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে গণভোট বাধ্যতামূলক হবে। জরুরি অবস্থার সিদ্ধান্ত নিতে প্রধানমন্ত্রী এককভাবে নয়, পুরো মন্ত্রিসভার অনুমোদন লাগবে এবং বিরোধী নেতা বা উপনেতার উপস্থিতিও আবশ্যক হবে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হবে সংসদের দুই কক্ষের সদস্যদের ভোটে। প্রার্থী হতে চাইলে কারও রাজনৈতিক বা সরকারি পদে থাকা যাবে না। রাষ্ট্রপতিকে মানবাধিকার কমিশন, আইন কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে স্বাধীনভাবে নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া হবে। একইসঙ্গে রাষ্ট্রপতির অভিশংসনের সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী পদের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব হলো—কেউ সর্বোচ্চ ১০ বছরের বেশি এ পদে থাকতে পারবেন না। এছাড়া, প্রধানমন্ত্রী হলে একইসঙ্গে দলীয় প্রধানের দায়িত্ব রাখা যাবে না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার
ভবিষ্যতের নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা আবার যুক্ত করা হয়েছে। এতে জটিল প্রক্রিয়ায় নির্বাচনকালীন প্রধান উপদেষ্টা বাছাইয়ের নিয়মাবলি নির্ধারণ করা হয়েছে। সময়সীমা ৯০ দিন, প্রয়োজনে সর্বোচ্চ ৩০ দিন বাড়ানো যাবে।
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ
সংসদকে দুই কক্ষ বিশিষ্ট করার সুপারিশ করা হয়েছে—নিম্নকক্ষ জাতীয় সংসদ এবং উচ্চকক্ষ ‘সিনেট’। উচ্চকক্ষে থাকবে ১০০ সদস্য, যাদের নির্বাচন হবে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে। নারীদের প্রতিনিধিত্ব ধাপে ধাপে ১০০ আসনে উন্নীত করা এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে ধীরে ধীরে ৩৩ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়নে বাধ্য করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
বিচার বিভাগ ও আইনজীবী সমাজে সংস্কার
প্রধান বিচারপতি নিয়োগে জ্যেষ্ঠতার নীতি কঠোরভাবে অনুসরণ এবং সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে স্বাধীন Judicial Appointments Commission (JAC) গঠনের প্রস্তাব এসেছে। বিচারকদের জন্য আচরণবিধি প্রণয়ন, স্বচ্ছ সম্পদ বিবরণী প্রকাশ এবং বার কাউন্সিলে দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করার সুপারিশও অন্তর্ভুক্ত।
নির্বাচন কমিশন ও দুর্নীতি দমন
নির্বাচন কমিশন গঠনে নিরপেক্ষ বাছাই কমিটি প্রস্তাব করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি রাজনৈতিক অর্থায়নে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার বিধান রাখা হয়েছে। প্রার্থীদের সম্পদ বিবরণী বাধ্যতামূলকভাবে প্রকাশ করারও নিয়ম আনা হয়েছে।
ঐকমত্য গঠনের প্রক্রিয়া
গত বছরের ৮ আগস্ট মুহাম্মদ ইউনূস (Muhammad Yunus) নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর একে একে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। পরে ১২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠিত হয়, যার কাজ ছিল এসব সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা ও সমঝোতা তৈরি। প্রায় ছয় মাসে ৩৮টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে ৪৭টি বৈঠক শেষে তৈরি হয় এই ‘জুলাই সনদ ২০২৫’।
সনদের চূড়ান্ত খসড়া এখন রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে পৌঁছেছে। তবে এই প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন হবে কি না—তা নির্ভর করছে দলগুলোর চূড়ান্ত অবস্থান ও আগামী নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে গৃহীত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর।