জামায়াত নেতাদের খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠকে তীব্র আগ্রহ

জামায়াতে ইসলামীর নেতারা বিএনপি (BNP) চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার (Khaleda Zia) সঙ্গে বৈঠকে বসতে তীব্র আগ্রহ দেখিয়েছেন। জুলাই সনদের আইনগত স্বীকৃতি ও রাজনৈতিক সমঝোতা প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সম্ভব হতে পারে এমন এক সময়ে এই আকাঙ্ক্ষার কথা সামনে এসেছে।

গত বছরের ৫ আগস্ট ‘ফ্যাসিস্ট’ শেখ হাসিনার পতনের পর দেশে পরিবর্তনের জোয়ার তৈরি হয় বলে দাবি করে একাধিক রাজনৈতিক দল ও পর্যবেক্ষক। এরই প্রেক্ষিতে সাংবিধানিক সংস্কার, রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান এবং অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমকে ঘিরে জাতির সামনে উঠে আসে নতুন এক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট।

২০২৫ সালের জুলাই সনদকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস (Muhammad Yunus)-কে সভাপতি করে সাত সদস্যের একটি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। সহ-সভাপতির দায়িত্ব পেয়েছেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ (Ali Riaz)।

এই কমিশন গত ছয় মাসে ৩০টিরও বেশি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে ৯৫টি প্রস্তাব সম্বলিত চূড়ান্ত জুলাই সনদের খসড়া তৈরি করেছে। এর মধ্যে ৮৪টি প্রস্তাবে সর্বসম্মত সমর্থন থাকলেও ১১টিতে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ রয়েছে।

তবে সবচেয়ে বিতর্কিত অংশ হলো জুলাই সনদের আইনগত স্বীকৃতি। একদিকে বিএনপিসহ কিছু রাজনৈতিক দল সংসদ বসার পর এই সনদ পাশ করাতে চায়। অন্যদিকে জামায়াত, এনসিপিসহ বেশিরভাগ দল মনে করছে সংসদ বসার আগেই আইনগত ভিত্তি দেওয়া প্রয়োজন, নইলে এটি রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য বিশ্বাসযোগ্য হবে না।

জানা গেছে, গত মঙ্গলবার মন্ত্রিপাড়ায় বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে একটি বৈঠক হয়। তবে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি। সূত্রগুলো বলছে, জামায়াত নেতারা বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সরাসরি বৈঠকে বসার জন্য বিশেষভাবে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তাদের বিশ্বাস, খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারলে অনেক রাজনৈতিক জট খুলে যাবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও বলছেন, জুলাই আন্দোলনের সম্মুখ সারির নেতাদের নিরাপত্তা, আইনগত স্বীকৃতি এবং জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে। তাদের মতে, সব সমস্যার মীমাংসা সম্ভব যদি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ইউনূস এবং বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া একসাথে বসেন। এমনকি এই আলোচনায় অন্য বড় দলের শীর্ষ নেতারাও অংশ নিতে পারেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন বলেন, “জুলাই আন্দোলনে ছাত্র-জনতা সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে। তাদের প্রত্যাশা পূরণ করাই এখন আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। সনদ বাস্তবায়ন না হলে সেই আস্থা নষ্ট হবে।”

লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ সতর্ক করে বলেন, “মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক দলগুলো যদি সনদে স্বাক্ষর করে, কিন্তু পরে তা মানতে না চায়, তাহলে জুলাই সনদ কাগুজে বাঘে পরিণত হতে পারে।”

অধ্যাপক ড. কাজী মাহবুবুর রহমান বলেন, “সব দলের উচিত আন্তরিকতা দেখিয়ে সরকার প্রধানের সঙ্গে আলোচনায় বসা। সরকার চাইলে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলের নেতাদের ডেকে সনদের চূড়ান্ত রূপ দিতে পারে। তাহলেই রাজনৈতিক সংকট অনেকটাই কেটে যাবে।”

বিএনপি তাদের পাঠানো মতামতে জানিয়েছে, সংবিধানের ওপর কিছুই থাকতে পারে না এবং যদি আদালতে প্রশ্ন তোলার সুযোগ না থাকে তবে নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হবে। সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন এমন প্রস্তাবগুলো আগামী সংসদে তোলা উচিত।

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী (Jamaat-e-Islami), এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদসহ সাতটি দল একযোগে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ও নির্বাচন-পূর্ব বাস্তবায়ন চায়। তারা বলছে, আইনি ভিত্তি না থাকলে আগামী সরকার সনদ বাতিল করে দিতে পারে—যা দেশের জন্য অস্থিতিশীলতা বয়ে আনবে।

জামায়াত ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মাসুদ স্পষ্ট বলেন, “জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি না থাকলে এর বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। যে দল ক্ষমতায় আসবে তারা যদি এটিকে বাতিল করে দেয়, তখন কিছুই করার থাকবে না।”

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, “এই সরকারকেই আইনি ভিত্তি দিয়ে বাস্তবায়নের স্পষ্ট পথ দেখাতে হবে, নতুবা সনদ শুধু একটি দলিল হয়েই থাকবে।”

এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, “আমরা চাই পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষে নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর পদে ও দলের নেতৃত্বে পৃথক ব্যক্তি থাকুক, এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দুই কক্ষের সদস্যদের গোপন ভোট কার্যকর হোক। এসব না মানলে এনসিপি সনদে স্বাক্ষর করবে না।”

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জুলাই সনদের আইনগত ভিত্তি নিশ্চিত না হলে এটি একটি ঐতিহাসিক সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো এখনই একটি কার্যকর সমঝোতায় না পৌঁছালে রাজপথে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে, যা কারো জন্যই কাঙ্ক্ষিত নয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *