অতি সম্প্রতি ডাকসু ও জাকসু নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচন যেভাবেই হোক না কেন এবং যত বিতর্কই থাকুক না কেন, তা এখন সর্বত্র আলোচনার বিষয়। শুধু নির্বাচনের মান কেমন ছিল, তা নিয়েই নয়—এ নির্বাচনের জাতীয় রাজনীতিতে কী প্রভাব ফেলবে, সেটি নিয়েও চলছে নানামুখী বিশ্লেষণ।
জামায়াত ইসলামী:
ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে শিবির (Shibir)-এর জয় যে জামায়াত (Jamaat)-এর মনোবল বাড়াবে, তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই। ৫ই আগস্টের পর থেকেই জাতীয় রাজনীতিতে দ্বিতীয় অবস্থান পাকাপোক্ত করার লড়াইয়ে থাকা এই দলটি এতদিন তাদের সব কর্মকাণ্ড সেই লক্ষ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছিল। কিন্তু এবারের ফলাফল তাদের কৌশলে নতুন মোড় আনতে পারে।
বিশেষ করে জুলাই আন্দোলনের অন্যতম দাবিদার এনসিপি (NCP)-র ভরাডুবির পর জামায়াত হয়তো মনে করছে অন্তত দ্বিতীয় অবস্থানে তাদের অবস্থান নিশ্চিত। ফলে এখন তারা হয়তো আর শুধু অবস্থান ধরে রাখার কৌশলে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং জাতীয় নির্বাচনের দিকে সরাসরি মনোযোগী হতে চাইবে। এর অংশ হিসেবে নির্বাচনী জোট গড়ার দিকেও তাদের মনোযোগ বাড়তে পারে।
তবে এই প্রক্রিয়ায় বড় একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে জাতীয় পার্টি (Jatiya Party)। রাজনৈতিক সমীকরণে এই দলের অবস্থানই মূলত ঠিক করবে জামায়াত কতটা দৃঢ়ভাবে জোটের দিকে অগ্রসর হবে নাকি এখনো তারা জাতীয় পার্টিকে ভোটার বাইরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাবে। তাই তাদের ভবিষ্যৎ কৌশল এখনো অনেকটা অনিশ্চিত রয়ে যাচ্ছে।
সবশেষে, জাতীয় রাজনীতিতে জামায়াতের অবস্থান কতটা বদলাবে, তা নির্ভর করছে এই ডাকসু-জাকসু নির্বাচনের ফলাফলকে তারা নিজেদের ভেতরে কেমনভাবে বিশ্লেষণ ও গ্রহণ করে তার ওপর। কেননা, এই জয়টি কীভাবে এসেছে—তা সবচেয়ে ভালো জানে তারাই।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি):
ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের ফলাফলে সবচেয়ে বড় ক্ষতির মুখে পড়েছে জুলাই আন্দোলনের দাবিদার জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) (NCP)। বিশেষ করে তাদের জন্মস্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ভরাডুবি দলটির জন্য কেবল বিব্রতকরই নয়, বরং ভবিষ্যৎ কৌশলগত অবস্থানের জন্যও গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই নির্বাচনে পরাজয়ের ফলে জোট রাজনীতিতে এনসিপির অবস্থান অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। একসময় যেই দরকষাকষির ক্ষমতা নিয়ে তারা রাজনৈতিক ময়দানে দাঁড়াতো, তা এখন প্রায় বিলীন হয়ে গেছে বলেই মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে নতুন দল হিসেবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রভাবশালী মুখ গুলোকে কেন্দ্র করেই তাদের উত্থান হয়েছিল। কিন্তু সেই একই পরিসরে যদি তারা এমন পরাজয়ের শিকার হয়, তবে জাতীয় রাজনীতিতে বা জাতীয় নির্বাচনে তাদের অবস্থা কী হতে পারে তা অনুমান করাই যায়।
এই ফলাফল শুধু একটি নির্বাচনী ব্যর্থতা নয়; বরং এটি এনসিপির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ও জোট রাজনীতিতে তাদের টিকে থাকার ক্ষমতা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি):
এবার আসি এই নির্বাচনে বিএনপি’র পাওয়া না পাওয়ার বিষয়ে। ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে যে ভরাডুবির মুখে পড়েছে বিএনপি (BNP), তা কেন্দ্রীয় থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত তাদের কানে কিছুটা হলেও পৌঁছানোর কথা। এমন ফলাফলের পর স্বাভাবিকভাবে প্রত্যাশা করা যায়, দলটি অন্তত নিজেদের ব্যর্থতার কারণ খুঁজতে উদ্যোগী হবে। তবে এর সম্পূর্ণ উল্টোটাও ঘটতে পারে—অর্থাৎ আত্মসমালোচনার পরিবর্তে তারা উল্টো আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে দেখা যায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করে এক ধরনের প্রবল এন্টিইনকামবেন্ট বা এন্টিএস্টাব্লিশমেন্ট ফ্যাক্টর। সাধারণত শিক্ষার্থীরা ক্ষমতাসীনদের বিপক্ষে দাঁড়ায়। ফলে দীর্ঘদিন ধরে ছাত্ররাজনীতির নির্বাচনে এমন প্রবণতা নিয়মিতই চোখে পড়ে এসেছে। প্রচলিত ধারণা হলো, আগামী ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি সরকার গঠনের সম্ভাবনা রয়েছে। এ কারণে দলের নীতি নির্ধারকদের অনেকেই মনে করতে পারেন, ছাত্রদলের ভরাডুবির মূল কারণও এখানেই নিহিত। শিক্ষার্থীরা সম্ভাব্য ক্ষমতাসীন দলের বিরোধিতা করার প্রবণতায় বিএনপির ছাত্রসংগঠনকেও প্রত্যাখ্যান করেছে।
এই ব্যাখ্যা যদি বিএনপি মেনে নেয়, তবে আত্মসমালোচনার পথে না গিয়ে উল্টো ভবিষ্যৎ নির্বাচনকে ঘিরে তারা আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে পারে। তবে সেই আত্মবিশ্বাস তাদের জন্য আশীর্বাদ হবে নাকি আত্মঘাতী ফাঁদ—এ প্রশ্ন এখনই জোরালো হয়ে উঠছে।
জাতীয় নির্বাচনের পাঁচ মাস আগে অনুষ্ঠিত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্বাচন একটি “গোল্ডফিশ মেমোরি” সদৃশ জাতির উপর কতটা প্রভাব ফেলতে পারবে, কিংবা এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব কী হবে—তা সময়ই নির্ধারণ করবে।