১৬ বছরের সীমাহীন দুঃশাসন, জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা—আর তার শেষ দৃশ্য যেন সদ্য ঘটে যাওয়া জুলাইয়ের গণহত্যা। এতসব ধ্বংসের পরও থামেনি আওয়ামী লীগ। দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ, গণতন্ত্রের চর্চা, নাগরিক অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, পরমতসহিষ্ণুতা—সবকিছু চূর্ণবিচূর্ণ করেই এখন বিদেশের মাটিতে দেশের সুনাম ক্ষুণ্ণ করতে নেমেছে দলটি। জাতিসংঘ অধিবেশনের মতো একটি আন্তর্জাতিক পরিসরে, বিশ্ব কূটনীতির কেন্দ্রস্থল নিউইয়র্ক শহরে, আবারও উগ্র রাজনৈতিক হিংস্রতার প্রদর্শনী ঘটিয়েছে নিষিদ্ধ সংগঠনটির নেতাকর্মীরা।
নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিতে আসা প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী রাজনৈতিক নেতাদের ঘিরে বেপরোয়া আচরণ করে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ (Awami League) ও তার সহযোগী সংগঠনের প্রবাসী নেতাকর্মীরা। গালিগালাজ, উত্ত্যক্ততা থেকে শুরু করে ডিম ছোঁড়ার মতো কুরুচিপূর্ণ কাজও তারা করতে দ্বিধা করেনি। এনসিপি সদস্য সচিব আখতার হোসেন ছিলেন এমন হামলার সরাসরি শিকার। তবে এটিই প্রথম নয়। আগেও বিদেশের মাটিতে এমন অসভ্য ও নিন্দনীয় আচরণের নজির রয়েছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাজনীতি বিশ্লেষকরা বিষয়টিকে অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছেন। সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির (M Humayun Kabir) বলেন, “এটি শুধু অসভ্যতা নয়, এর ফলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। রাজনৈতিক দলের বিদেশি শাখা নিষিদ্ধ করলে এ ধরনের ঘটনা বন্ধ হতে পারে।” তিনি আরও বলেন, “দেশের প্রচলিত আইনে এমন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের সুযোগ থাকলেও রাজনৈতিক সদিচ্ছাই মুখ্য।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (University of Dhaka) রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, “যারা প্রবাসে থাকেন, তারা প্রত্যেকে দেশের প্রতিনিধি। সেখানে গিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি মানে পুরো বাংলাদেশকে হেয় করা। রাজনৈতিক ক্ষোভ থাকতেই পারে, কিন্তু সেটা প্রকাশেরও শালীনতা থাকতে হবে।”
ঘটনার পেছনের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ তুলে ধরেন বিশ্লেষক ডা. জাহেদ উর রহমান। তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার স্বপ্ন দেখেছিল—২০৪১ বা ২০৭১ সাল পর্যন্ত। সেই স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার হতাশা থেকেই এখন তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছে এবং যাকে পাচ্ছে তাকেই আক্রমণ করছে।” তিনি যোগ করেন, “এগুলো শুধু রাজনৈতিক সহিংসতাই নয়, বরং কূটনৈতিকভাবে দেশকে বিপদে ফেলার ষড়যন্ত্র।”
এমন প্রেক্ষাপটে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিক্রিয়াও এসেছে কড়া ভাষায়। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী (Amir Khasru Mahmud Chowdhury) বলেন, “রাজনৈতিকভাবে পরাজিত হয়ে এখন পালিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই আওয়ামী লীগের। তাই এই ধ্বংসাত্মক রাজনীতি।” তিনি আরও বলেন, “তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না, তাই দেশ ধ্বংস করে এখন বিদেশেও সেই অপচেষ্টা চালাচ্ছে।”
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর (Bangladesh Jamaat-e-Islami) নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের নিউইয়র্কে বলেন, “এটা নিঃসন্দেহে ব্যাড কালচার। যারা করেছে, তারাই বাংলাদেশের সম্মান ক্ষুণ্ণ করেছে। এটা লজ্জাজনক।”
এনসিপি (NCP) দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, “প্রবাসে আমাদের নেতাদের ওপর হামলা, সরকারের গাফিলতি এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতা প্রকটভাবে ধরা পড়েছে। আমরা এর জবাবদিহিতা চাই।” তিনি অভিযোগ করেন, “প্রশাসনের লোকজন হামলাকারীদের তথ্য দিয়েছে—সরকার এসব হামলা ঠেকাতে চায়নি, বরং মদদ দিয়েছে।”
এই অশ্লীল, বর্বর রাজনীতির চর্চা শুধু দেশের অভ্যন্তরেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং এখন তা বিশ্বের দরবারেও পৌঁছে গেছে। যে দেশের নেতারা জাতিসংঘের অধিবেশনে গিয়ে দেশের উন্নয়নের গল্প শোনাতে যান, তাদেরই দলের কর্মীরা বিমানবন্দরে ডিম ছুড়ে, গালাগাল করে সেই দেশের পরিচয়কে কলঙ্কিত করছে। প্রশ্ন উঠছে—আওয়ামী লীগের এ কী সর্বনাশা রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা?