বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শেষ মুহূর্তে জঙ্গিকার্ড খেলার পরিকল্পনা করেছিলেন সাবেক ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও হাসানুল হক ইনু। হাসিনা ও ইনুর মধ্যকার এক কল রেকর্ডের এই কথোপকথন শোনা যায়। সেই কল রেকর্ডটি গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ প্লে করে শোনানো হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ দেয়া জবানবন্দিতে বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, শেখ হাসিনার ৬৯টি অডিও ক্লিপ ও ৩টি মোবাইল নম্বরের সিডিআর জব্দ করা হয়। ওই কল রেকর্ডের মধ্যে একটিতে হাসিনা ও হক ইনুর মধ্যকার কথোপকথনে শোনা যায় যে….
হাসানুল হক ইনুঃ হ্যালো জি স্লামালাইকুম। আমি ইনু বলছিলাম। হ্যালো…
শেখ হাসিনাঃ হ্যাঁ বলেন।
হাসানুল হক ইনুঃ জি, না আমি একটু পরিস্থিতি অনুযায়ী একটু উদ্বেগের ভেতরে ছিলাম। তো আমি মনে করি যে সিদ্ধান্তটা খুব সঠিক হয়েছে আরকি। তো আমি যেটা বলতে চাচ্ছিলাম যে কারফিউটা একটু কঠোর কারফিউ আরকি ভাবে, তো সারা ঢাকা শহরে যদি মাইক নামায়ে দিতো প্রশাসন থেকে কারফিউ কি করা উচিত না… তাহলে একটু সুবিধা হতো মনে হয়।
শেখ হাসিনাঃ আমি হোম মিনিস্টারকে বলছি এখনি, সব জায়গায় মাইকিং করার জন্য..চারজন আহত…জেলায় জেলায় ডিসি অফিস…
হাসানুল হক ইনুঃ হ্যাঁ ওইগুলা সব পেয়েছি আমি, ডিসি অফিস, এসপি অফিস, আওয়ামীলীগের বাড়ি, আওয়ামীলীগ অফিস, এইগুলার প্রত্যেকের লিস্ট আমি পেয়েছি…..
শেখ হাসিনাঃ আমি এখন ঢাকায় আসবো।
হাসানুল হক ইনুঃ আচ্ছা তো এখন আমার কথা হচ্ছে যে কারফিউটা মানে এমন হবে যে ঘর থেকে বের হলেই অ্যারেস্ট করবে, গুলি হবে না, সেটা আপনার আমার ভেতরে, গুলি নাই কিন্তু সেনাবাহিনীর ভাবটা এমন হবে, কঠোর মানে কঠোর একেবারে। তো সেইজন্য…
শেখ হাসিনাঃ আজকে আমি, সত্যি কথা বলতে কি, বলি আপনাকে। আমি… কমিটি আছে তো…মিটিং করছিলাম, করার আগেই আমি দিছি… তিন বাহিনীর প্রধানের সাথে বসছিলাম….
হাসানুল হক ইনুঃ এটা দেখছি
শেখ হাসিনাঃ বললাম যে একটু সিচুয়েশনটা একটু ভালো হচ্ছে। তাহলে আস্তে আস্তে আর্মি, যেসব জেলা শান্ত আছে, ওইখান থেকে উঠায় ফেলো আর এইখানে আস্তে আস্তে গ্র্যাজুয়ালি তুলে ফেলো। এই ডিসিশনটা দিয়ে দিছি৷
হাসানুল হক ইনুঃ আচ্ছা।
শেখ হাসিনাঃ মানুষ একটু ইয়ে থাকুক। ওমা, ওইখানে বসা অবস্থায় শুনলাম যে, শুরু হয়ে গেছে।
হাসানুল হক ইনুঃ ওতো টার্গেটেড। উপজেলা লেভেলেরও ইউএনও অফিস ভাঙচুর করছে…
শেখ হাসিনাঃ …. পরিনাম শুনলাম তখন আমি বললাম যে ঠিকাছে….তোমরা বলো কী করবা…কারফিউটা আগায় দিচ্ছে আর কি পয়েন্টগুলি যেগুলি ওদের কতগুলি জায়গা ওরা সিলেক্ট করছে যেখানে হামলা করবে…ভার প্রটেকশন দেবে আর… র্যাব, পুলিশ টহল দেবে আর সেনাবাহিনীর অবশিষ্টর মধ্যে…যেখানে যেখানে প্রয়োজন হয় তোমরা টহল দেবো। যেটা বলছো ওইটা ঠিক…. ওই প্রেসারটা থাকতে হবে।
হাসানুল হক ইনুঃ প্রেসারটা থাকতে হবে, মানে প্রেসারটা থাকতে হবে, আরেকটা হচ্ছে যেটা কালকে আলাপ করছিলাম যে আপনার পার্টি নেটওয়ার্কে আমাদের পার্টি নেটওয়ার্কে … রেডি করা যে কারফিউ উঠে গেলে এক লাখ লোক ঢাকা দখল করবো আমরা। বসবো।
শেখ হাসিনাঃ … ওরা জেলায় আসবে, আমাদেরও জেলা থেকে লোক আসতে চাচ্ছে… বলছি ঠিকাছে আসেন।
হাসানুল হক ইনুঃ হ্যাঁ এটা আনা দরকার আমি মনে করি, এটা কারেক্ট
শেখ হাসিনাঃ না আসুক…
হাসানুল হক ইনুঃ আমি কালকে বলছিলাম মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে শহীদ মিনার, শাহবাগ চত্বর, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে, প্রেসক্লাবের সামনে, পল্টনে …
শেখ হাসিনাঃ … আমাদের নিয়ে নিতে হবে
হাসানুল হক ইনুঃ এটা আমরা নেবো, আমরা বসবো এইখানে এবং কারফিউ যেদিন রিলাক্স হবে সেদিনই মিছিলের নগরী হয়ে যাবে একেবারে। এবং কিছুই না, শান্তি চাই, শাস্তি চাই, ছাত্ররা বাড়ি যাও, ফেরত যাও, ফেরত যাও, সন্ত্রাস দমন করো…
শেখ হাসিনাঃ আচ্ছা আমি এটা কলে দিতে বলছি। যে তোমরা ছাত্ররা সব ঘরে ফেরো। গার্ডিয়েনদের বলছি এইখানে কিন্তু জঙ্গি হামলা হইছে।
হাসানুল হক ইনুঃ হ্যাঁ রাইট রাইট।
শেখ হাসিনাঃ না এইটা আমাকে … বেশ কিছু আন্তর্জাতিক ইয়ে পাইছি। তারা এইটাকে জঙ্গি হামলা হিসেবে কনসিডার মানে বলতেছে।
হাসানুল হক ইনুঃ হ্যাঁ, জঙ্গি হামলাই হইছে…এই কার্ডটা খেলবো আমরা এখন।
শেখ হাসিনাঃ না কার্ড খেলা না, এটা আমি আগে করি নাই কিন্তু আমাকে আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে আমাকে মেসেজটা দিছে যে এটা জঙ্গি হামলা…
হাসানুল হক ইনুঃ জঙ্গি সন্ত্রাসের মোকাবিলা করছে এখন সরকার ।
শেখ হাসিনাঃ …তারা আমাকে এইটাই বলছে যে এইটা জঙ্গি হামলা… দিয়ে দেবো পেপারে ।
হাসানুল হক ইনুঃ আচ্ছা এইটা একটা ব্যাপার, আরেকটা হচ্ছে যে, দুইটা ভাগ, একটা হচ্ছে ছাত্রদের কোটা আন্দোলনকারী, একটা হচ্ছে উৎখাতকারী, উৎখাতকারীরা জঙ্গি সন্ত্রাসী হামলায় চলে গিয়েছে। কোটা সংস্কারকারীর ব্যাপারে আপনার আমার সরকারের যা যা আছি সমবেদনা আছে। উৎখাতকারীকে আমি রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করবো, কোনো ছাত্র যদি উৎখাতকারীর সঙ্গে জড়িত হয়, সেই দায়িত্ব আমি নেবো না।
শেখ হাসিনাঃ …এটা আপনারা বলেন, এটা আপনারা বলেন না কেনো?
হাসানুল হক ইনুঃ আমি তো বলবো…
শেখ হাসিনাঃ আরে আমি তো ক্র, আপনারা বললে তখন মনে করবে যে অন্যান্য এঙ্গেল থেকে বলা হইছে।
হাসানুল হক ইনুঃ আমি ভো অবশ্যই বলবো…..
শেখ হাসিনাঃ বাকি দেখতেছিনা, কমিউনিস্ট পার্টি তারা এখন শেষ হয়ে গেছে…
হাসানুল হক ইনুঃ তো দেখি আমি ওদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করি সেলিম সবার সঙ্গে।
শেখ হাসিনাঃ …কি জানি উনার নাম? সাইফুল হক নাকি?
হাসানুল হক ইনুঃ সাইফুল সাইফুল। জোনায়েদ সাকি। জোনায়েদ সাকি, সাইফুল হক। আচ্ছা আমি জোনায়েদ সাকি, সাইফুল হকের সাথে একটু লিয়াজোঁ করি।
শেখ হাসিনাঃ তোমরা কোথায় নিচ্ছো দেশটাকে? ওদের মধ্যে যে সমর্থন দিচ্ছো তা এখন দেখো পুরা জঙ্গি হামলা হচ্ছে।
হাসানুল হক ইনুঃ আরেকটা পয়েন্ট কি খেয়াল করছেন আপনি যে আনু মুহাম্মদেররা সরি শিক্ষকরা যারা সমর্থন দিছে তারা একটা অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা … করার চেষ্টা করছে যেখানে বলতে চাচ্ছে যে অন্তর্বর্তী সরকার শিক্ষার্থীদের নিয়ে হেন-তেন নিয়ে হবে, ছায়া সরকার করবে এবং সংবিধান বাতিল করার জন্য একটা সংবিধান সভা করতে হবে। মানে সংবিধানই বাতিল করে দেবে…হ্যাঁ সংবিধান বাতিল চায়। আমি….ভাইকে একটু আগে বলছি যে মাইনুল ভাই এটা খুবই অ্যালার্মিং কথা, যেখানে বঙ্গবন্ধুর মূর্তি আর ম্যুরাল ভেঙে ফেলতেছে তার মানে আমার পয়েন্টটা নিতে হবে যে এদের এট্যাকটা হচ্ছে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের বেসিক অর্জনের উপরে। সুতরাং তারা তো বালি সরকার বদল চাচ্ছে না, মানে কোটা আন্দোলন করে কোটা চায়নি তারা সরকার উৎখাত করতে চাইছে। আর এক দফা আন্দোলনের মানে তারা হচ্ছে সরকারের মানে রাষ্ট্রের বেসিক সংবিধান উড়ায় দিচ্ছে চাচ্ছে তারা। তারমানে এই জায়গায় পলিটিক্সটা এট্যাক করতে হবে আমাকে, দাঁড় করাইতে হবে এখন।
শেখ হাসিনাঃ ওই যে সেভেনটি ফাইভের পর করছিল…..
হাসানুল হক ইনুঃ এক্সাক্টলি, তো এখন আপনি কি অ্যাডজাস্ট করবেন এইটা ছোটোখাটো পাঁচ-দশ মিনিটের…আরও দুই-একদিন পরে?
শেখ হাসিনাঃ আজকের দিনটা যাক দেখি ।
হাসানুল হক ইনুঃ আজকের দিনটা যাক, আমি প্ল্যানগুলা সাজাই আপনাকে আমি আমার বিবেচনা যেগুলা আছে দিবোনি আপনাকে। আর আমি বলি যে কারফিউটা বডি ল্যাংগুয়েজে অনেক কঠোর হবে যে ঘর থেকে বের হলেই অ্যারেস্ট গুলি না মানে অ্যারেস্ট করে ভেসে আসবে মানে টেলিভিশনে যে শান্তিনিকেতন থেকে ৩০জন অ্যারেস্ট হইছে, জেলে পাঠানো হইছে, কিন্তু জেলে পাঠাবো না, থানায় রাখবো, ১০ ঘণ্টা পরে ছেড়ে দেবেন আরকি। বুঝলেন না?
শেখ হাসিনাঃ বেশ, আচ্ছা।
হাসানুল হক ইনুঃ গরিব মানুষই তো। কিন্তু প্রোপাগান্ডা হবে ঘর থেকে বেরোলেই, মানে গুলি হবে, গুলি শব্দ বলবো না, আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে কঠোর। কেউ ঘরের বাইরে বেরোবে না। মানে রিল্যাক্স কারফিউ না আরকি। আপনার অফিসের মানে বাসার চারপাশে একটু মানে এই মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর এখান থেকে প্রোটেকশন বাড়ান…..
শেখ হাসিনাঃ …
হাসানুল হক ইনুঃ না ওইটা না, ওরা যে ঢাকা চলো বলছে, গণভবন আক্রমণ করবে এইগুলা বলছে…
শেখ হাসিনাঃ গণভবন, বঙ্গভবন সব আক্রমণ করবে….
হাসানুল হক ইনুঃ তা ঠিক আছে, আল্লাহ ভরসা। আমি, আমার কথা হচ্ছে যে আমাদের পরে যে জনতার ঢাকা এইটা প্রমাণ করার জন্যে হোমওয়ার্কটাই আজকের ২৪ ঘণ্টায় করে ফেলতে হবে। এভরি ওয়ার্ডে থেকে দুই হাজার লোক রেডি করতে হবে। এভরি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর দুই হাজার রেডি করতে হবে এবং জেলাগুলোতেও আমি আমার যত নেটওয়ার্ক আছে আমি বলছি কারফিউ উঠবে, সাথে সাথে মিছিল বের হবে কুষ্টিয়া শহরে তিন হাজার লোকের পাঁচ হাজার লোকের, রংপুর শহরে, ময়মনসিংহ শহরে, মানে শাস্তি চাই, সংঘাত চাই না, শান্তি চাই, শান্তি চাই, ছাত্ররা ঘরে ফেরত যাও। এই মিলি দখল করে নিতে হবে।
শেখ হাসিনাঃ ঠিকাছে, আপনারা আগে বলেন যে ছাত্ররা পরে যাও।
হাসানুল হক ইনুঃ আমিও বলতেছি, আমি অবশ্যই বলবে। কিন্তু আপনার পার্টিটাকে একটু চাঙা করেন।
শেখ হাসিনাঃ আমি ক্রনে দিয়ে দিছে দেখেন এখন চলে আসছে।
হাসানুল হক ইনুঃ আচ্ছা ঠিকাছে ওকে। ঠিকাছে।
শেখ হাসিনাঃ ঠিকাছে। আচ্ছা।
এ মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়া অপর দুই আসামি হলেন, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
এ মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন তদন্ত সংস্থার উপ-পরিচালক মো. জানে আলম খান। পরে তদন্ত করেন উপ-পরিচালক মো. আলমগীর (পিপিএম)। সার্বিক সহযোগিতা করেছিলেন বিশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা তানভীর হাসান জোহা।
এ ঘটনায় তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর গত ১২ মে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। পরবর্তীতে ৩১ মে সম্পূরক অভিযোগ দেওয়া হয়। ১ জুন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়।
গত ১০ জুলাই এ মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। একইসঙ্গে সাবেক আইজিপি মামুন নিজেকে ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হিসেবে যে আবেদন করেছেন, তা মঞ্জুর করেন ট্রাইব্যুনাল।