ভোটের হালচাল: বরিশাল-৫ আসনে হাফ ডজন হেভিওয়েট প্রার্থী নিয়ে বিপাকে বিএনপি

বরিশাল-৫ (সদর) আসনকে সব সময়ই দক্ষিণাঞ্চলের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দেখা হয়। বলা হয়ে থাকে, এই আসন থেকেই গোটা বিভাগের রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা নির্ধারিত হয়। স্বাধীনতার পর থেকে এই আসনে বিভিন্ন সময় প্রভাবশালী নেতারা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। বিএনপি (Bangladesh Nationalist Party) এ আসনটিকে ঐতিহ্যগতভাবে নিজেদের ঘাঁটি মনে করে। ১৯৭৯ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দু’টি উপনির্বাচনসহ মোট আটবারের নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়েছে। এর মধ্যে চারবার বিজয়ী হন দলীয় উপদেষ্টা এডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার (Mojibur Rahman Sarwar), একবার সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাস (Abdur Rahman Biswas), দু’বার তাঁর পুত্র প্রয়াত নাসিম বিশ্বাস ও একবার সুনীল কুমার গুপ্ত। আওয়ামী লীগ ১৯৭৩ সালে একবার এবং জাতীয় পার্টি ১৯৮৬ সালে জয়ী হয়। ২০১৪ সালের পর থেকে এ আসনে আওয়ামী লীগ ধারাবাহিকভাবে বিজয়ী হয়ে আসছে।

মনোনয়ন দৌড়ে হেভিওয়েটদের ভিড়
আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে আবারও বরিশাল-৫ আসনে জমে উঠেছে মনোনয়নের লড়াই। দলীয় প্রার্থিতা পেতে আগ্রহী বিএনপির শীর্ষ স্থানীয় অন্তত ছয়জন নেতা। এর মধ্যে রয়েছেন দলীয় চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মজিবর রহমান সরোয়ার ও সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল।

মজিবর রহমান সরোয়ার বরিশাল-৫ থেকে সর্বাধিক চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, যুগ্ম মহাসচিব এবং বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র। জাতীয় সংসদে হুইপ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের কারণে বরিশালে তাঁর একটি শক্তিশালী ভোট ব্যাংক গড়ে উঠেছে।

অন্যদিকে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক এমপি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল (Syed Moazzem Hossain Alal) একসময় কেন্দ্রীয় যুবদলের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি ছিলেন। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার সময় সরোয়ারের সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব দলীয় রাজনীতিতে আলোচনায় ছিল। সে সময় স্থানীয় প্রভাব কমে গেলে আলালকে ঢাকায় মনোনয়ন দেয় বিএনপি। ২০২৪ সালের নির্বাচনে তিনি অংশ নেননি, কারণ হিসেবে বলেছিলেন, “খালেদা জিয়া কারাগারে থাকা অবস্থায় নির্বাচনে যাওয়া ঠিক নয়।” এবারে তাঁর সমর্থকেরা চান, তিনি বরিশাল-৫ থেকে নির্বাচন করুন।

এছাড়া মনোনয়নপ্রত্যাশীদের তালিকায় রয়েছেন জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আবু নাসের মুহাম্মদ রহমতউল্লাহ, মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান ফারুক, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এবায়েদুল হক চাঁন, দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব এডভোকেট আবুল কালাম শাহীন ও মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আফরোজা খানম নাসরিন।

অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও কাদা ছোড়াছুড়ি
মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে বিভক্তি তীব্র আকার নিয়েছে। সভা-সমাবেশ চলছে আলাদাভাবে, আবার কেউ কেউ একে অপরের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অভিযোগ তুলছেন। সম্প্রতি রহমতউল্লাহর দেওয়া এক সাক্ষাৎকারকে কেন্দ্র করে দলের দুই নেতা আবুল হোসেন খান ও আবুল কালাম শাহীন তাঁর বিরুদ্ধে বিবৃতি দেন, যেখানে তাঁকে ‘জাতীয় পার্টির উচ্ছিষ্টভোগী’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়। পালটা বিবৃতিতে রহমতউল্লাহ বলেন, “এই ধরনের আচরণ রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত এবং দলের ঐক্য নষ্টের সামিল।”

এদিকে আফরোজা নাসরিনের একটি বক্তব্য ভাইরাল হয়েছে, যেখানে তিনি সরোয়ার ও মনিরুজ্জামান ফারুকের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দখলবাজি এবং ফ্যাসিস্ট তোষণের অভিযোগ তোলেন। বক্তব্যে নাসরিন বলেন, “সরোয়ারের দুই ভাই নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল দখল করে অবৈধভাবে লাখ লাখ টাকা আয় করছেন।”

মনিরুজ্জামান ফারুককে উদ্দেশ করে তিনি অভিযোগ করেন, “আপনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করে চলেছেন।” তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামিম ও সাবেক মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর সঙ্গে ফারুকের ছবি দেখিয়ে বলেন, “আমাদের কাছে প্রমাণ আছে।”

অভিযোগের পাল্টা জবাব
অভিযোগের জবাবে ফারুক বলেন, “নাসরিন যাদের সঙ্গে চলাফেরা করেন, তারা ফ্যাসিস্ট দলের কুখ্যাত সন্ত্রাসী। আমার বিরুদ্ধে যেসব ছবি দেখানো হয়েছে, তা পারিবারিক বা সামাজিক অনুষ্ঠানের।” তিনি ব্যাখ্যা দেন, “২০২১ সালে আমার স্ত্রী মারা গেলে সাদিক আবদুল্লাহ সমবেদনা জানাতে এসেছিলেন, আরেকটি ছবি তোলা হয়েছিল স্থানীয় স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায়।”

অন্যদিকে নাসরিন বলেন, “আমি পারিবারিক ব্যবসা থেকে অর্থ উপার্জন করি, বাস কেনার জন্য কোনো অবৈধ উৎস নেই। আমার সঙ্গে আওয়ামী লীগের কারও ঘনিষ্ঠতা প্রমাণ করতে পারলে তারা দেখাক।”

সরোয়ারের প্রতিক্রিয়া
মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, “সবচেয়ে দুঃখজনক হলো দলে চেইন অব কমান্ড না থাকা। নেতৃত্ব নিয়ে মতবিরোধ থাকতে পারে, কিন্তু তাই বলে সংগঠন নষ্ট করা যাবে না।” নিজের ভাইদের বিষয়ে তিনি বলেন, “আমার ভাইয়েরা শ্রমিক ইউনিয়ন বা মালিক সমিতির কোনো পদে নেই। যদি প্রমাণ পাওয়া যায় তারা চাঁদাবাজি করছে, দল যে ব্যবস্থা নেবে আমি তা মেনে নেব।”

ইসলামী আন্দোলন ও অন্যান্য দলের প্রস্তুতি
বিএনপি ছাড়াও এই আসনে প্রার্থী দিচ্ছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ (Islami Andolan Bangladesh)। তাদের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে সিনিয়র নায়েবে আমীর ও চরমোনাই পীরের ভাই মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীমকে। ২০১৮ সালের মতো এবারও তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকবেন। অপরদিকে, জামায়াতে ইসলামী (Jamaat-e-Islami) প্রার্থী করেছে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এডভোকেট মুয়াযয্‌ম হোসাইন হেলালকে।

এ ছাড়া জাতীয় পার্টি (Jatiya Party)-র প্রার্থী হিসেবে ব্যবসায়ী ইকবাল হোসেন তাপস নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। তফসিল ঘোষণার পর আরও কিছু দল প্রার্থী দিতে পারে বলে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা চলছে।

সব মিলিয়ে বরিশাল-৫ আসনে বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, জোট রাজনীতির সমীকরণ এবং ইসলামী রাজনৈতিক শক্তির সক্রিয় অংশগ্রহণ—সবকিছু মিলিয়ে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন এই আসনে হতে যাচ্ছে সবচেয়ে আলোচিত প্রতিদ্বন্দ্বিতার এক কেন্দ্র।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *