এনআইডি জালিয়াতি করে ‘বাংলাদেশি পরিচয়’ অর্জন, সরকারি চাকরিতে রোহিঙ্গা যুবক

কক্সবাজারের সেন্টমার্টিনের কোনপাড়া এলাকার বাসিন্দা পরিচয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) তৈরি করে সরকারি চাকরি বাগিয়ে নিয়েছেন রোহিঙ্গা যুবক আব্দুল আজিজ। ২০১৭ সালে জাল তথ্য দিয়ে এনআইডি সংগ্রহের পর তিনি বর্তমানে পরিবেশ অধিদপ্তরের আউটসোর্সিং কর্মী হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন। একইসঙ্গে তিনি সেন্টমার্টিন বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির অধীনে কর্মরত। এনআইডি তৈরির সময় তিনি স্থানীয় বাসিন্দা আলী আহমদ ও নুর নাহারকে যথাক্রমে বাবা ও মা হিসেবে দেখান, যদিও বাস্তবে তার বাবা একজন মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিক ছিলেন। এনআইডিতে জন্মসাল দেখানো হয়েছে ১৯৯২ সালের ১ জানুয়ারি—যে বছর তার পরিবার বাংলাদেশে আসে।

স্থানীয় সূত্র বলছে, আজিজ এনআইডি তৈরিতে সহায়তা পেয়েছেন সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক মেম্বার আব্দুর রউফের কাছ থেকে। তবে আব্দুর রউফ এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি কিছু জানি না, হয়তো দালালদের মাধ্যমে এনআইডি করেছে।’ আজিজের প্রকৃত পরিচয় জানতে সেন্টমার্টিনের একাধিক স্থানীয়ের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিনি মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা নাগরিক মো. আব্দুলের ছেলে। ২০০০ সালে তার বাবা মারা যান, পরবর্তীতে তার মা বিয়ে করেন আলী আহমদকে।

আলী আহমদ নিজেও দাবি করেছেন, ‘আজিজ আমার ছেলে নয়। তার মা মারা যাওয়ার এক বছর পর আমি বিয়ে করি। দালালদের সহায়তায় আমাকে বাবা বানিয়ে এনআইডি করানো হয়েছে।’ স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ হাসেম জানান, ‘আজিজ আসলে রোহিঙ্গা। কিন্তু প্রভাবশালীদের সহায়তায় বাংলাদেশি পরিচয়ে সরকারি চাকরি করছেন।’

সড়ক নির্মাণে চাঁদা দাবির অভিযোগ

পরিবেশ অধিদপ্তর ১৯৯৯ সালে সেন্টমার্টিনকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (Ecologically Critical Area) হিসেবে ঘোষণা দেয়। দ্বীপের পরিবেশ রক্ষায় বিভিন্ন প্রকল্পের অংশ হিসেবে সেখানে মেরিন পার্কসহ নানা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। স্থানীয় সূত্র জানায়, সম্প্রতি গলাচিপা থেকে দক্ষিনপাড়া পর্যন্ত দুই কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের কাজ পেয়েছে এফএক্স নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এই নির্মাণকাজ চলাকালে আব্দুল আজিজ নিজেকে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মী পরিচয়ে হাজির হয়ে সিমেন্ট, তেল ও ১০০ বস্তা বালু চাঁদা হিসেবে দাবি করেন।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক বসন্ত দে বলেন, ‘আজিজ আমাদের কাজ দেখতে এসে বলেন, তার দপ্তরের পক্ষ থেকে কোনো সমস্যা হবে না, তবে ১০০ বস্তা বালুসহ সিমেন্ট ও তেল দিতে হবে। আমরা বুঝিয়ে বলি কাজ শেষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, কিন্তু সে পরবর্তীতে লোকজন নিয়ে এসে ঝামেলা করার চেষ্টা করেন।’

দ্বৈত চাকরির অভিযোগ

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, আব্দুল আজিজ একাধিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছিলেন—একদিকে বিচ কর্মী, অন্যদিকে পরিবেশ অধিদপ্তরের আউটসোর্সিং কর্মী হিসেবে। এটি সরকারি চাকরির নিয়মবিরোধী হওয়ায় ২০২২ সালের শেষের দিকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরে তিনি লিখিত অঙ্গীকার দেন যে, পরিবেশ অধিদপ্তরের চাকরি ছাড়ছেন। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই আবারও সেই দপ্তরের কাজে যুক্ত হন।

এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে আব্দুল আজিজ বলেন, ‘আমি কাউকে চাঁদা দাবি করিনি। সঠিক কাগজপত্র দিয়েই এনআইডি বানিয়েছি। কিছু চক্র আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তবে আলী আহমদ আমার প্রকৃত বাবা নন, এটা সত্য।’

প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (Sheikh Ehsan Uddin) বলেন, ‘ভুল তথ্য দিয়ে এনআইডি তৈরি করা গুরুতর অপরাধ। চাঁদা দাবির বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (Khandaker Mahmud Pasha) বলেন, ‘আব্দুল আজিজ আমাদের দপ্তরে চুক্তিভিত্তিক আউটসোর্সিং কর্মী হিসেবে কাজ করেন। তার বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা হওয়ার অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাব।’

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (Shahidul Alam) বলেন, ‘আজিজের বিরুদ্ধে এনআইডি জালিয়াতি এবং চাঁদা দাবির অভিযোগ পাওয়া গেছে। তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *