এনসিপি জামায়াতের সাথে জোটে গেলে, জোট জয়ী হলে নাহিদ হবেন প্রধানমন্ত্রী , এনসিপিকে জামায়াতের অফার

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের গড়া দল এনসিপিকে ভোটের মাঠে সঙ্গে পেতে চায় বিএনপি। আলোচনা এগোলেও এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত কোনো সমঝোতা হয়নি বলে জানিয়েছেন উভয় দলের নেতারা। তবে বিএনপি নতুন এই দলটিকে তাদের জোটবদ্ধ করতে না পারলেও জামায়াত থেকে দূরে রাখতে চায়।

অন্যদিকে ভোটের মাঠে গণঅভ্যুত্থানের আবেগ পক্ষে রাখতে এনসিপির সঙ্গে জোট না হলেও অন্তত নির্বাচনী সমঝোতা করতে আগ্রহী জামায়াতে ইসলামী। এনসিপি নেতারা জানিয়েছেন, আগামী ফেব্রুয়ারির সংসদ নির্বাচনে জামায়াত প্রত্যাশিত সংখ্যক আসনে ছাড় এবং নির্বাচনে সব রকম সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে তাদের সঙ্গে গেলে ডানপন্থি ‘ট্যাগের’ ভয় রয়েছে। আবার বিএনপি পাশে চাইলেও প্রত্যাশিত সংখ্যক আসন ছাড়তে রাজি নয়। এ দলটির সঙ্গে গেলে নির্বাচনে প্রত্যাশিত সহায়তা পাওয়া যাবে কিনা, তা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে এনসিপি নেতাদের।

বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি– তিন দলের নেতারাই জানিয়েছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের দুই ছাত্র উপদেষ্টা বিএনপির সঙ্গে এনসিপির নির্বাচনী ঐক্যে আগ্রহী। এনসিপি সূত্র জানিয়েছে, এই ঐক্য না হলে উপদেষ্টাদের অন্তত একজন ঢাকায় বিএনপির দলীয় প্রতীকে প্রার্থী হতে পারেন।

জামায়াত সূত্র সমকালকে নিশ্চিত করেছেন, উপদেষ্টারাই এনসিপির সঙ্গে নির্বাচনী জোট বা সমঝোতায় মূল বাধা। তাদের কারণেই এনসিপির সঙ্গে একাধিক বৈঠকের পরও দলটি জুলাই সনদের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের দাবিতে জামায়াতের যুগপৎ আন্দোলনে আসেনি।

পর্দার আড়ালে সমঝোতার আলোচনা
গত সোমবার ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সাক্ষাৎকারে বলেন, বিএনপি অন্য দলকে নিয়ে সরকার গঠনে প্রস্তুত। এসব দলের মধ্যে গত বছর অভ্যুত্থানে সামনের কাতারে থাকা ছাত্রদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা একটি নতুন দলও রয়েছে।

তারেক রহমানের এই বক্তব্যে বিএনপির সঙ্গে এনসিপির নির্বাচনী সমঝোতার বিষয়টি জোরালোভাবে সামনে এসেছে। দুই দলের নেতারা পারস্পরিক যোগাযোগের কথা স্বীকার করলেও, দাবি করেছেন– জোট বা আসন বণ্টনের আলাপ নেই।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেছেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী সব দলের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। এর অংশ হিসেবে এনসিপির সঙ্গেও সংস্কারবিষয়ক আলোচনা রয়েছে। কিন্তু নির্বাচনী সমঝোতার কথা হয়নি। যখন নির্বাচন আসবে, তখন দেখা যাবে। ফ্যাসিবাদবিরোধী অন্যান্য দলের মতো এনসিপির সঙ্গে সমঝোতা হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে।

বিএনপি সূত্র জানিয়েছে, এনসিপিকে জামায়াত থেকে দূরে রাখাই লক্ষ্য। অন্য দলের মতো বিএনপির সঙ্গেও আলাপ-আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। তিনি বলেছেন, নির্বাচনী জোট বা সমঝোতার আলাপ হয়নি।

এনসিপির একজন যুগ্ম আহ্বায়ক সমকালকে বলেছেন, দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এ বিষয়ে আলোচনা চালাচ্ছেন। যুগপৎ আন্দোলনে এনসিপিকে যুক্ত করতে গত মাসে তাঁর বনশ্রীর বাসায় গিয়েছিলেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। এতে সাড়া না দিয়ে নাহিদ ইসলাম বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এনসিপি ৫০-৬০ আসনে ছাড় পেলে জোটের বিষয় ভাববে।

তবে নাহিদ ইসলামের বক্তব্য জানতে পারেনি সমকালকে। এনসিপি সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেছেন, কোনো দলের সঙ্গে এখনও জোটের সিদ্ধান্ত হয়নি।
বিএনপির মতো জামায়াতও এনসিপির সঙ্গে সমঝোতার আলোচনার কথা স্বীকার বা অস্বীকার করছে না।

জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের গত রোববার সমকালকে বলেছেন, শুধু এনসিপি নয়, ফ্যাসিবাদবিরোধী সবার সঙ্গেই আন্দোলনের ঐক্য হতে পারে। নির্বাচনী সমঝোতা হতে পারে।

বিএনপিতে স্বতন্ত্রের ভয়
এনসিপির একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা সমকালকে জানিয়েছেন, নতুন এ দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে আগামী সংসদে প্রতিনিধিত্ব থাকা জরুরি বলে মনে করছেন তারা। বিএনপির সঙ্গে থাকলে যেসব আসনে ছাড় পাওয়া যাবে, সেগুলোতে জয়ের সম্ভাবনা বেশি। বিএনপি ২৫-৩০ আসনে ছাড় দিলে এর অধিকাংশেই জয়ী হওয়া সম্ভব। তবে সমস্যা হলো, আর্থিক ও সাংগঠনিক সামার্থ্য না থাকা।

একজন নেতা সমকালকে বলেছেন, বিএনপি কেন্দ্রীয়ভাবে আসন ছাড়লেও দলটির স্থানীয় নেতাকর্মীদের সমর্থন এনসিপির প্রার্থীর পক্ষে পাওয়া যাবে কিনা– এ আশঙ্কা রয়েছে।

এনসিপির তিন জ্যেষ্ঠ নেতা সমকালকে বলেছেন, বিএনপি কেন্দ্রীয়ভাবে আসন ছাড়লেও স্থানীয় নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন না– এ নিশ্চয়তা নেই। সম্প্রতি নির্বাচনী আইন সংশোধন হওয়ায় এক দলের প্রার্থী আরেক দলের প্রতীকে নির্বাচনের সুযোগ নেই। ধানের শীষ পেতে হলে সরাসরি বিএনপির প্রার্থী হতে হবে। ফলে এনসিপি নেতাদের নিজ প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে। নির্বাচনী এলাকায় ধানের শীষ না থাকলে ১৬ বছর ধরে নির্বাচনের জন্য মুখিয়ে থাকা বিএনপি নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারেন। তখন সাংগঠনিক এবং আর্থিক সামর্থ্যে পিছিয়ে থাকা এনসিপির প্রার্থীরা মাঠে টিকতে পারবেন না।

বিএনপির এক জ্যেষ্ঠ নেতা বলেছেন, যেখানে ধানের শীষ থাকবে না, সেখানে যদি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে যায়, তাহলে কীভাবে আটকানো যাবে।

জামায়াতের সঙ্গে ট্যাগের ভয়
এনসিপির একাধিক নেতা সমকালকে বলেছেন, জামায়াতের সঙ্গে গেলে এই সমস্যা নেই। কিন্তু ডানপন্থি তকমা পেতে হবে। এনসিপি নেতাদের একাংশ বাম ঘরানা থেকে এসেছেন। তারা জামায়াতের ঘোর বিরোধী। আবার দলের বড় অংশ মধ্যপন্থি রাজনীতি করতে চায়।

যুগপৎ আন্দোলনের জন্য জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির বৈঠকের পর দলটির একাংশ থেকে এই বার্তা আসে। উপদেষ্টা মাহফুজ আলম গত মাসে ফেসবুকে লেখেন, ইতোমধ্যে অর্ধডজন মওদুদীবাদী দল রাজনীতিতে রয়েছে। আরেকটি বাড়লে নতুন কিছু তৈরি হবে না।

এর মাধ্যমে জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির সমঝোতার বিরুদ্ধে কড়া বার্তা দেন এনসিপির পদে না থাকলেও প্রভাব রাখা মাহফুজ আলম। দলটির তিন নেতা সমকালকে বলেছেন, জামায়াতের সঙ্গে গেলে ৫০-৬০ আসনে অনায়েসে ছাড় পাওয়া যাবে। জামায়াতের সংগঠন এবং জনবল বিনা খরচে শতভাগ কাজ করবে এনসিপির প্রার্থীর পক্ষে। জামায়াতের কেউ বিদ্রোহী হবেন না নিশ্চিত। কিন্তু রাজনৈতিক স্বকীয়তা ধরে রাখা তখন কঠিন হবে।

নাহিদকে নেতা মানবে না জামায়াত
জামায়াত ও এনসিপি দুই পক্ষই জানিয়েছে, ডানপন্থি তকমা এড়াতে নাহিদ ইসলামকে জামায়াতের সম্ভাব্য জোটের নেতা করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। যেভাবে ২০১৮ সালে ড. কামাল হোসেন বিএনপি জোটের নেতা ছিলেন। এনসিপি বলেছিল, জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান নন, নাহিদ গণঅভ্যুত্থানের নেতা হিসেবে জোটকে নেতৃত্ব দেবেন। জোট জয়ী হলে প্রধানমন্ত্রী হবেন।

জামায়াত নেতারা সমকালকে বলেছেন, এ প্রস্তাব অবান্তর। এই নেতারা জানান, ডাকসু নির্বাচনে এনসিপিকে জিএসসহ কয়েকটি পদ ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল জামায়াত। কিন্তু নাহিদ ভিপি পদের জন্য অনড় ছিলেন। নির্বাচনে এনসিপির সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের প্যানেলের ভরাডুবি হয়েছে। সংসদ নির্বাচনেও জামায়াত নেতৃত্ব হাতছাড়া করবে না। জামায়াতের সঙ্গে চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনসহ সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী দল রয়েছে। তারাও এতে সম্মত হবে না।

জামায়াতের এক জ্যেষ্ঠ নেতা সমকালকে বলেছেন, তাদের জরিপ অনুযায়ী, সারাদেশে এনসিপির ৩ থেকে ৪ শতাংশ ভোট রয়েছে। কিন্তু সংগঠন না থাকায় তারা তা পাবে না। তার পরও জামায়াত দলটির প্রতি আগ্রহী অভ্যুত্থানের প্রতি জনগণের ভাবাবেগের কারণে। জামায়াতের মূল্যায়ন হলো, আগামী নির্বাচনে চব্বিশের আবেগ কাজ করবে। এনসিপিকে সঙ্গে রাখলে এই আবেগ বিএনপির দিকে যাবে না।

এনসিপিকে টানতে উদ্যোগ
গণতন্ত্র মঞ্চের ছয় শরিক দল জেএসডি, নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন এবং ভাসানী জনশক্তি ২০১৯ সাল থেকে বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের মিত্র। গণঅধিকার পরিষদও বিএনপির মিত্র দল। এবি পার্টি সরাসরি যুগপৎ আন্দোলন না থাকলেও বিএনপির ঘনিষ্ঠ। এনসিপিসহ এই ৯ দল জুলাই জাতীয় সনদের প্রশ্নে কাছাকাছি এসেছে।

সংস্কারের সংলাপে জামায়াতকে প্রতিনিধিত্ব করা এক নেতা বলেন, প্রত্যেক দলকেই আসন ছেড়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে বিএনপি। এ কারণে দলগুলো অবস্থান বদল করছে। এনসিপিও এখন আর দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র, গণপরিষদ এবং নতুন সংবিধানের দাবির কথা জোরালোভাবে বলে না। ছাত্র সংসদের নির্বাচনে পরাজয়ের কারণে তারা এখন জামায়াতকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছে। মনে করছে, বিএনপির সঙ্গে জোট করলে আগামী সংসদে যেতে পারবে। আর বিএনপির লক্ষ্য হলো, জামায়াতকে যথাসম্ভব বন্ধুহীন করা। এ কারণেই বিএনপি ছোট দলগুলোকে নিয়ে জোট গঠনে সর্বোচ্চ ছাড় দেওয়ার কৌশল নিয়েছে।

হেফাজতের প্রভাব
জামায়াতের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে রয়েছে মাওলানা মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস এবং খেলাফত আন্দোলন। এ দুটি দল এনসিপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। দলটির সূত্র জানিয়েছে, এ দুটি দলকে নিজেদের জোটে চায় এনসিপি।

এবি পার্টি, গণঅধিকারসহ কয়েকটি দল নিয়ে নিজেই জোট করার চেষ্টা করছে এনসিপি। দলটির মূল্যায়ন, যদি তা সম্ভব হয় তবে বিএনপির সঙ্গে আসন নিয়ে দরকষাকষিতে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকতে পারবে।

বাংলাদেশ খেলাফতের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা সমকালকে বলেছেন, বিএনপি, জামায়াত এবং এনসিপি– তিন দলই মাওলানা মামুনুল হককে পাশে চাইছে। হেফাজতে ইসলামের ‘মুরব্বিরা’ জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতার ঘোর বিরোধী। জামায়াতকে ভোট না দেওয়ার আহ্বান পর্যন্ত জানিয়েছেন হেফাজত আমির মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী। এ পরিস্থিতিতে বিএনপির মতো এনসিপিও হেফাজতের সমর্থন পেতে চাইছে, যাতে হেফাজত প্রভাবিত কওমি মাদ্রাসা ঘরানার ইসলামী দলগুলো তাদের সঙ্গে যায়। সূত্র : সমকাল

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *