মাদারীপুরে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর জেলা সমন্বয় কমিটির সদস্য মেরাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে একের পর এক অনৈতিক কর্মকাণ্ড, নারী কেলেঙ্কারি ও ব্ল্যাকমেইলের অভিযোগে উত্তাল হয়ে উঠেছে স্থানীয় জনতা। সম্প্রতি তার সঙ্গে এক নারীর অশ্লীল ভিডিও কল, কল রেকর্ড এবং আপত্তিকর ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটেছে এলাকাজুড়ে।
মেরাজুলের বিরুদ্ধে অভিযোগের তালিকা দীর্ঘ—বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে নারীকে ফাঁদে ফেলা, টাকা আত্মসাৎ, ভয়ভীতি প্রদর্শন, নারী কুপ্রস্তাব, পুলিশ দিয়ে হয়রানি এবং অবৈধ বালু ব্যবসা পর্যন্ত। এক ভুক্তভোগী নারী সেনাবাহিনীর কাছে লিখিত অভিযোগে বলেছেন, তিন বছরের প্রেমের সম্পর্কের পর বিয়ের আশ্বাসে মেরাজুল তাকে অনৈতিক সম্পর্কে জড়ান। পরে গোপনে ছবি তুলে ২ লাখ টাকা ব্ল্যাকমেইল করে আদায় করেন। বারবার টাকা দাবি করে ও হুমকি দিতে থাকায় প্রথমে রাজৈর থানায় এবং পরে সেনা ক্যাম্পে অভিযোগ জানান ওই নারী।
ফাঁস হওয়া ৬ মিনিট ৫৫ সেকেন্ডের একটি ভিডিও কল রেকর্ডে শোনা যায়, এনসিপি সদস্য মেরাজুল ইসলাম এক নারীর সঙ্গে নিজের গড়ে তোলা শারীরিক সম্পর্ক নিয়ে অশ্লীল আলোচনা করছেন। একপর্যায়ে গালিগালাজ ও হুমকি দিয়ে নারীকে কথা বলতে বাধ্য করেন তিনি। পরে নারীটি কলটি কেটে দেন।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নারী কেলেঙ্কারি ও আর্থিক দুর্নীতির কারণে মেরাজুলকে পরপর চারটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল—থ্রি-ডি ডিজিটাল স্কুল, ইকরা স্কুল, কিডস ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ও মডেল স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়। স্কুল পরিচালকদের অভিযোগ, তিনি প্রতিষ্ঠানগুলোর টাকা আত্মসাৎ করেন এবং নারী শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কুপ্রস্তাব দেন।
থ্রি-ডি ডিজিটাল স্কুলের পরিচালক আরিফুজ্জামান টিপু বেগ বলেন, “আমাদের স্কুল থেকে নারীঘটিত কেলেঙ্কারি ও টাকা আত্মসাতের কারণে মেরাজুলকে চাকরি থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরবর্তীতে একই অভিযোগে আরও তিনটি স্কুল থেকেও তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।”
স্কুলছাত্রীর এক অভিভাবক নারী, যিনি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, জানান, মেরাজুল রাতে ফোন করে বিরক্ত করতেন। একদিন তার বাবা ফোন ধরলে বিষয়টি স্কুল কর্তৃপক্ষকে জানান এবং তারা দ্রুত ব্যবস্থা নেয়।
৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর সুযোগ নিয়ে মেরাজুল ইসলাম এনসিপিতে যোগ দেন এবং দ্রুত মাদারীপুর জেলা সমন্বয় কমিটির সদস্য পদ দখল করেন। এরপর থেকেই তিনি রাজৈর উপজেলার শংকরদী, হোসেনপুর, পাইকপাড়া ও তাঁতিকান্দাসহ নদী-উপকূলবর্তী এলাকায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, তার এই বালু ব্যবসায় বাধা দিলে হামলারও ঘটনা ঘটেছে।
এছাড়া, মোখলেস মিনা নামের এক ইউপি সদস্য অভিযোগ করেন, তাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে মোটা অংকের টাকা দাবি করেছেন মেরাজুল ও তার অনুসারীরা। বিষয়টি স্বীকার করলেও নিরাপত্তার ভয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে চাননি তিনি।
গোপালগঞ্জ সদর থানার একটি মিথ্যা মামলার অভিযোগপত্রে বিভিন্ন নেতাকর্মীর নাম ঢুকিয়ে লাখ লাখ টাকা আদায়ের অভিযোগও উঠেছে মেরাজুলের বিরুদ্ধে।
এমন ভয়াবহ সব অভিযোগের বিপরীতে নিজের অবস্থান জানিয়ে মেরাজুল বলেন, “সব অভিযোগ মিথ্যা। কেউ যদি প্রমাণ দিতে পারে, আমি মেনে নেবো।” তবে ভিডিও ফাঁস প্রসঙ্গে তিনি দাবি করেন, “আমার একটি ফোন হারিয়ে গেছে। সেটিতে কী ছিল, আমি জানি না।”
মাদারীপুর জেলার এনসিপির যুগ্ম সমন্বয়কারী আজগর শেখ জানান, “এনসিপি বড় হচ্ছে। কিছু সুবিধাভোগী স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে যোগ দিচ্ছেন। তবে মেরাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে কেন্দ্রীয় কমিটিকে জানানো হবে।”
এ বিষয়ে রাজৈর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাহফুজুল হক বলেন, “বালু উত্তোলন নিয়ে ইতিমধ্যে একটি মারামারির ঘটনা ঘটেছে। পাইকপাড়াতেও অবৈধ উত্তোলনের অভিযোগ পেয়েছি। আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে, কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।”