বিতর্কিত অনিষ্পন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্তের ভার সরকারের উপর ছেড়ে দিয়ে আজ জমা পড়ছে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ

গণভোটের নির্ধারিত দিনক্ষণ ও বাস্তবায়নের আদেশ কাদের মাধ্যমে জারি হবে—এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত সরকারের ওপর ছেড়ে দিয়ে আজ মঙ্গলবার অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ বাস্তবায়নের সুপারিশ তুলে দেবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন (National Consensus Commission)। সংবিধান সংস্কারের লক্ষ্যে প্রণীত এই গুরুত্বপূর্ণ সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াটি স্পষ্ট করতে কমিশন তিন ধাপের সুপারিশ চূড়ান্ত করেছে।

কমিশনের সূত্র জানায়, প্রথম ধাপে গণঅভ্যুত্থানকে ভিত্তি করে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) আদেশ’ জারি, দ্বিতীয় ধাপে গণভোট এবং তৃতীয় ধাপে আগামী সংসদকে দ্বৈত ভূমিকায়—সংবিধান সংস্কার পরিষদ ও সংসদ—কাজ করার সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই আদেশ জারি করবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস (Muhammad Yunus) নাকি রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সেটি হবে, সেই সিদ্ধান্তও সরকারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে কমিশন। যদিও জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) প্রধান উপদেষ্টার মাধ্যমে আদেশ জারি করার পক্ষে, বিএনপি এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করছে।

গেল সোমবার বিকেলে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বসেন কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজসহ অন্য সদস্যরা। সেখানেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়, আজ মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এই সুপারিশ জমা দেওয়া হবে।

কমিশনের অন্যতম সদস্য বদিউল আলম মজুমদার (Badiul Alam Majumdar) বলেন, “সনদ স্বাক্ষরের পর আমরা নতুন এক জটিলতার মুখে পড়েছি। তবে আমরা বাস্তবায়নের একটি সুপারিশ চূড়ান্ত করেছি, যেটি আজ সরকারের হাতে তুলে দেওয়া হবে।”

কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন (সংবিধান সংস্কার) আদেশ’ নামে একটি আদেশ জারি করা হবে। তার অধীনে একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে গণভোট আয়োজন করা হবে। পরবর্তী সংসদের প্রথম ৯ মাসে একটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের মাধ্যমে সেই সংস্কারগুলো বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। পুরো প্রক্রিয়াটি আদেশে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ থাকবে, কোন ধারা কবে থেকে কার্যকর হবে তাও নির্দিষ্ট থাকবে।

এছাড়া, আদেশের শুরুতে প্রেক্ষাপট হিসেবে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার ভিত্তিতে সংবিধান সংস্কার বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। গণভোটে পাস হলে সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবসমূহ পরবর্তী সংসদের প্রথম ৯ মাসে বাস্তবায়ন করা হবে। সংসদ তখন স্বাভাবিক কাজের পাশাপাশি ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ হিসেবে কাজ করবে।

যদি নির্ধারিত সময়ে প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়িত না হয়, সে ক্ষেত্রে বিকল্প ব্যবস্থার কথাও উল্লেখ করেছে কমিশন। আদেশ অনুযায়ী, একটি পূর্ণাঙ্গ বিল তৈরি করে গণভোটের মাধ্যমে তা অনুমোদনের চেষ্টা করা হবে। আর যদি এই প্রক্রিয়ায়ও সফলতা না আসে, তাহলে বিলের বিষয়বস্তু স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হয়ে যাবে।

অন্য একটি প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সংবিধান সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো বিল আকারে চার মাসের মধ্যে সরকারের প্রস্তুত করতে হবে। এরপর বিলটি গণভোটে উপস্থাপন করা হবে। সংবিধান সংস্কার পরিষদ এই বিলের শব্দ বা বাক্য পরিবর্তন না করে কেবল আলোচনার মাধ্যমে ব্যাখ্যার সুযোগ পাবে। যদি ৯ মাসের মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে সমাধান না হয়, তাহলে ২৭১তম দিনে বিলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানের অংশ হয়ে যাবে। সেই প্রেক্ষাপটে গণভোটে দুইটি প্রশ্ন রাখা হতে পারে—এক, আপনি কি ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) আদেশ’ অনুমোদন করেন? দুই, আপনি কি বিলের প্রস্তাবসমূহ বাস্তবায়নে একমত?

সূত্র মতে, দুই ধাপের সংলাপে অর্জিত ঐকমত্য অনুযায়ী সনদের সঙ্গে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব আদেশের পরিশিষ্টে সংযুক্ত থাকবে। তবে কোনো দলের ভিন্নমত বা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ অন্তর্ভুক্ত থাকবে না। ৪৭টি প্রস্তাব সরাসরি সংবিধান সংশ্লিষ্ট হওয়ায় এসব নিয়ে মতভিন্নতা থাকায় নোট অব ডিসেন্ট সংযুক্ত না করেই গণভোটে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

যদিও দলগুলো গণভোটের প্রয়োজনীয়তা ও বৈধতা বিষয়ে একমত হয়েছে, কিন্তু এর দিনক্ষণ, কাঠামো এবং ভিন্নমতের প্রস্তাব বাস্তবায়ন নিয়ে বিএনপি (BNP), জামায়াতে ইসলামী (Jamaat-e-Islami) ও এনসিপির মধ্যে তীব্র মতপার্থক্য রয়েছে। এ কারণেই কমিশন গণভোটের দিনক্ষণ নির্ধারণের দায়িত্ব সরকারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে।

এ ছাড়া কমিশন সুপারিশ করেছে, সংবিধান সংস্কার পরিষদে পাস হলে পরবর্তী সংসদে অনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠনের বিষয়টিও সংবিধানে যুক্ত করা যেতে পারে।

উল্লেখ্য, গত ১৭ অক্টোবর আয়োজিত সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো ৩০টি দল ও জোটের মধ্যে ২৫টি অংশ নেয়। এর মধ্যে ২৪টি দল সেদিনই স্বাক্ষর করলেও গণফোরাম দুদিন পর সই করে। এনসিপি, সিপিবি, বাসদ, বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদ সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়নের রূপরেখা না দেখে সই করতে রাজি হয়নি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *