জাতিসংঘকে চিঠি দিয়ে নির্বাচনে সহায়তা বন্ধের আহ্বান করল ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ

নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচনের বাইরে থাকলেও জাতিসংঘকে নির্বাচন সহায়তা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ (Awami League)। শনিবার ঢাকায় জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) প্রতিনিধি স্টেফান লিলার বরাবর পাঠানো এক চিঠিতে তারা ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নয়’—এমন নির্বাচনে জাতিসংঘের সম্পৃক্ততা না রাখার অনুরোধ জানিয়েছে।

চিঠিটি পাঠিয়েছেন দলটির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল (Mohibul Hasan Chowdhury Nowfel)। চিঠিতে বলা হয়েছে, “অবাধ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা জাতিসংঘ এবং ইউএনডিপির প্রতি নির্বাচনি সহযোগিতা স্থগিত করার আহ্বান জানাচ্ছি। একইসঙ্গে জাতীয় সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে মানবাধিকার ও আইনের শাসনের ভিত্তি মজবুত করার অনুরোধ জানাচ্ছি।”

চিঠির শিরোনাম ছিল: ‘বাংলাদেশে ইউএনডিপির নির্বাচনি সহযোগিতা এবং জাতিসংঘ সনদের নিরপেক্ষতা, রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি এবং মৌলিক অধিকারের মূলনীতি লঙ্ঘনের বিষয়ে উদ্বেগ’। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় ইউএনডিপির সম্পৃক্ততা ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য’ নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের ম্যান্ডেট লঙ্ঘনের ঝুঁকি তৈরি করছে।

আওয়ামী লীগ চিঠিতে আরও দাবি করে, “বর্তমানে দেশে রাজনৈতিক দমন-পীড়নের পরিবেশ বিরাজ করছে। হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী ও নাগরিক আটক বা হুমকির মুখে। কোনো সংলাপ বা রাজনৈতিক ঐকমত্যের সুযোগ নেই। পাশাপাশি উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে, যা অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্যদের দ্বারা উসকানি পাচ্ছে।”

চিঠিতে বলা হয়, “আমরা বিশ্বাস করি, শক্তিশালী নির্বাচনি প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ, তবে তা হতে হবে মৌলিক স্বাধীনতা ও অংশগ্রহণমূলক পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। আমরা জাতিসংঘকে আহ্বান জানাচ্ছি, ইউএনডিপির ভূমিকা যেন কাউকে বাদ দেওয়া বা নিপীড়নের হাতিয়ার না হয়।”

চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের রাজনীতির সাম্প্রতিক ইতিহাস আবারও আলোচনায় আসে। উল্লেখযোগ্য যে, ২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বিপুল ব্যবধানে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। কিন্তু ২০১১ সালে সংবিধান সংশোধন করে সেই ব্যবস্থাই বাতিল করে তারা। এরপর ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচন আওয়ামী লীগের অধীনেই অনুষ্ঠিত হয়, যেগুলো ঘিরে ব্যাপক বিতর্ক ও বিরোধী দলের বর্জনের ঘটনা ঘটে।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয় আওয়ামী লীগ, যা ভোটবর্জনকারী বিএনপি (BNP) ‘বিনা ভোটের সংসদ’ হিসেবে আখ্যা দেয়। একাদশ নির্বাচনকে বলা হয় ‘নীশিরাতের নির্বাচন’—কারণ ভোট গ্রহণের আগেই ব্যালট পেপারে সিল পড়ার অভিযোগ ওঠে। দ্বাদশ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী বিরোধীদলগুলোর অভাব পূরণ করতে আওয়ামী লীগ শরিক দল জাতীয় পার্টির (Jatiya Party) জন্য আসন ছেড়ে দেয় এবং নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে, যার নাম হয়ে যায় ‘আমি আর ডামি’ নির্বাচন।

এই তিন নির্বাচন ঘিরে জনমনে আস্থা সংকট তৈরি হয় বলে পর্যবেক্ষণ দেয় হাই কোর্ট। ২০২4 সালের জানুয়ারিতে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটে। পরে মে মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে এবং দল হিসেবে তাদের নিবন্ধন স্থগিত করে নির্বাচন কমিশন।

এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে না পারলেও জাতিসংঘকে দেওয়া চিঠিতে দলটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, “বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি, সব দলের অংশগ্রহণ ও সত্যিকারের সংলাপ প্রয়োজন।”

চিঠিটি এমন এক সময় দেওয়া হলো, যখন জাতিসংঘের সদ্য বিদায়ী আবাসিক সমন্বয়ক গোয়েন লুইস (Gwyn Lewis) একটি বক্তব্যে বলেন, “অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন মানে হচ্ছে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষ যেন ভোট দিতে পারে—নারী, ১৮ বছর বয়সী তরুণ, সংখ্যালঘু ও ধর্মীয় গোষ্ঠী। এটি কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের বিষয় নয়।”

ডিক্যাব টক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে কিনা—এমন প্রশ্নে গোয়েন লুইস স্পষ্ট করেন, জাতিসংঘ রাজনৈতিক দলের বিষয়ে নয়, বরং জনগণের অংশগ্রহণে বিশ্বাসী।

অবশেষে, ‘গণভোটে হার’ কিংবা ‘অংশগ্রহণমূলক ব্যর্থতা’ নয়—আন্তর্জাতিক সহায়তার প্রশ্নে আওয়ামী লীগের এই চিঠি আসলে একটি কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টির চেষ্টা বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *