আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে দেশের রাজনৈতিক মঞ্চে সমীকরণ বদলের হাওয়া আরও প্রবল হচ্ছে। এমন এক সময়, দুই প্রধান জোটের বাইরে থাকা এনসিপি (NCP) এখন পড়েছে এক গভীর রাজনৈতিক দ্বিধা ও ত্রিমুখী সংকটে। দলটির সামনে রয়েছে তিনটি সম্ভাব্য পথ—প্রতিটি পথেই রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ঝুঁকি, চাপ আর রাজনৈতিক মূল্যের হিসাব।
সিদ্ধান্তহীনতায় এনসিপি
এনসিপি (NCP)-র একাধিক অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, তারা এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। দলের কৌশলপ্রণেতারা মূলত সময় নিচ্ছেন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে। কোন পথে গেলে দলের রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্য, ভবিষ্যৎ ভাবমূর্তি ও সংগঠনের মাঠপর্যায়ের অবস্থান কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে—তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আবার দলের মধ্যেই তিনধারা নিয়েও বিপাকে দলটি। কেউ চাচ্ছে বিএনপি’র সাথে জোটে যেয়ে কিছু আসনের নিশ্চয়িতা। আবার ডান ঘরানা থেকে আসা নেতাদের ইচ্ছা জামাতের সাথে জোটে যাবার। ইচ্ছা থাকলেও তকমা লাগার ভয়ে মুখ ফুটে তেমন উচ্চস্বরে বলতে পারছে না তাদের ইচ্ছার কথা। আবার অন্য একটি ধারা নিজেদের স্বাতন্ত্র বৈশিষ্ট নিয়ে এগিয়ে চলার পক্ষে। এই পক্ষের ইচ্ছা ছোট ছোট দল নিয়ে একটি জোট গঠনের। এমন অবস্থায় প্রথম থেকেই দলটির সাথে থাকা দুই ছাত্র উপদেষ্টার নীরবতাও বিপাকে ফেলেছে দলটিকে।
জামায়াতের সঙ্গে জোট: আত্মপরিচয়ের ঘোরতর প্রশ্ন
রাজনৈতিক মহলে সবচেয়ে বেশি আলোচনা ছিল জামায়াতে ইসলামী (Jamaat-e-Islami)-র সঙ্গে এনসিপির সম্ভাব্য জোট নিয়ে। কিন্তু এই পথে পা রাখলে দলটিকে অবিলম্বে ‘জামায়াতের বি-টিম’ বলে ট্যাগ দেওয়া হবে—যা তাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদে বড় এক রাজনৈতিক বোঝায় পরিণত হতে পারে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জামায়াতের সঙ্গে গাঁটছড়া মানেই আদর্শিক প্রশ্ন জেগে উঠবে। এনসিপি ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে সমর্থন করে কি না, কিংবা কতটা দূরত্বে দাঁড়াতে চায়—সেসব প্রশ্ন আরও তীব্রভাবে সামনে আসবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এই জোট নেতিবাচক বার্তা দিতে পারে।
বিএনপির সঙ্গে: মাঠে গতি, পরিচয়ে ঘোলাটে
অন্য একটি দৃশ্যপট হলো বিএনপি (BNP)-র সঙ্গে জোট। সামনে সামনে এই জোট নিয়ে তেমন আলোচনা না হলেও ভিতরে ভিতরে এমন জোটের প্রস্তুতি অনেকটাই এগিয়েছিল বলে জানা যায়। এতে হয়তো নির্বাচনী মাঠে বাড়তি গতি আসতে পারে, কিন্তু দল হিসেবে এনসিপির আলাদা পরিচয় ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।
বিএনপির সঙ্গে থাকলে কিছু আসন বা আলোচনায় স্থান পাওয়া সম্ভব—তবে প্রশ্ন থাকবে: এনসিপি কি তাহলে কেবলই একটি ‘ছায়া দল’? তাদের আলাদা আদর্শিক অবস্থান কোথায়? আরও বড় আশঙ্কা হলো, বিএনপির নিজের সংগঠনের নেতাদেরই মনোনয়ন দিতে হিমশিম খাচ্ছে – সেখানে এনসিপিকে কিছু আসনে কেন্দ্র থেকে ছাড় দেওয়া হলেও মাঠের রাজনীতিতে তারা কতটুকু পেরে উঠবেন – এই নিয়ে এনসিপি’র ভিতরে রয়েছে নানা আলোচনা। ছাড় পেলেও কয়টি আসনে তারা জিতে আসতে পারবেন তা নিয়ে সন্দিহান নিজেরাও।
ছোট দল–নির্ভর জোট: কৌশলগত নিরাপদ, বাস্তবে দুর্বল
তৃতীয় বিকল্প হিসেবে আছে ছোট দলগুলোকে নিয়ে একটি নতুন জোট গঠন। কাগজে-কলমে এটি ‘নিরপেক্ষ’ এবং নিরাপদ মনে হলেও বাস্তব রাজনীতিতে এটি সবচেয়ে দুর্বল বিকল্প। কারণ, এসব ছোট দলের নেই উল্লেখযোগ্য ভোটব্যাংক, সংগঠন বা মাঠপর্যায়ের প্রভাব।
ফলে এই ধরনের জোট অনেক সময়ই কেবল ‘জোট’ নামেই টিকে থাকে, কার্যকর রাজনীতির মঞ্চে তাদের অবস্থান থাকে দুর্বল। নির্বাচনী সুবিধা বা রাজনৈতিক বার্তা—দুটো ক্ষেত্রেই তাদের সক্ষমতা থাকে সীমিত।
যে দিকেই যায়, সংকট অনিবার্য
একদিকে জামায়াতের সঙ্গে গেলে পরিচয় সংকট—ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রশ্নে সমালোচনার ঝড়। অন্যদিকে বিএনপির সঙ্গে গেলে অস্তিত্ব সংকট—নিজস্বতা হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। আর ছোট দল নিয়ে গেলে কার্যকারিতা সংকট—রাজনীতিতে প্রভাবশালী হয়ে ওঠার সুযোগ নেই।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ভাষ্য অনুযায়ী, এনসিপির প্রধান সংকট আদর্শিক দিক নির্ধারণে তাদের ধোঁয়াশা। তারা এখনো নিজ অবস্থান স্পষ্ট করেনি, ফলে প্রতিটি সম্ভাব্য জোটেই দলটির ওপর চাপ বাড়ছে—সমালোচনা, সন্দেহ, এমনকি আন্তর্জাতিক চাপও।
অবস্থা এমন যে, এনসিপির সামনে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন—”কোন পথে গেলে ক্ষতি সবচেয়ে কম হবে?” আসন্ন সপ্তাহগুলোতে তারা যে সিদ্ধান্তই নিক, তা শুধু দলের ভবিষ্যৎ নয়, দেশের অবস্থানভিত্তিক রাজনীতির ভারসাম্যও বদলে দিতে পারে।


