পিলখানা হত্যাকাণ্ড পরিকল্পিত: শেখ হাসিনা ও তাপস জড়িত, তদন্ত কমিশনের বিস্ফোরক প্রতিবেদন

২০০৯ সালের পিলখানা হত্যাকাণ্ড নিয়ে গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর ও গুরুতর অভিযোগ। প্রতিবেদনে স্পষ্ট বলা হয়েছে, বিডিআর বিদ্রোহের আড়ালে সংঘটিত এ ঘটনা ছিল সম্পূর্ণ পরিকল্পিত। এতে সরাসরি জড়িত ছিল তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ (Awami League)।

কমিশনের মতে, এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে প্রধান সমন্বয়কের ভূমিকায় ছিলেন তৎকালীন সংসদ সদস্য এবং পরবর্তীকালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস (Sheikh Fazle Noor Taposh)। এমনকি ঘটনাটি ঘটানোর জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘গ্রিন সিগন্যাল’ বা সবুজ সংকেত ছিল বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

রোববার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় তদন্ত কমিশনের প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান কমিশনের রিপোর্ট প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন কমিশনের অন্যান্য সদস্য এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমানসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপ্রাপ্তরা।

প্রতিবেদনে বলা হয়, হত্যাকাণ্ডের পর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা জড়িতদের রক্ষা করেছেন। ঘটনার সময় পিলখানায় প্রবেশ করেছিল ২০-২৫ জনের একটি মিছিল, কিন্তু বেরিয়ে আসে দুই শতাধিক লোক। কমিশন এ ঘটনাকে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেও চিহ্নিত করেছে। তদন্তে বহিঃশক্তির সরাসরি সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে, যার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করেছে দেশীয় রাজনৈতিক মহল।

কমিশনপ্রধান ফজলুর রহমান বলেন, “আমরা চেষ্টা করেছি প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে। কেন সেনাবাহিনী কোনও অ্যাকশন নেয়নি, তা আমরা খতিয়ে দেখেছি।” তিনি আরও বলেন, “১৬ বছর আগের ঘটনাটি তদন্ত করা কঠিন ছিল। অনেক আলামত ধ্বংস হয়ে গেছে, অনেক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। তবে সাক্ষীদের ঘন্টার পর ঘন্টা শুনে এবং পুরনো তদন্ত রিপোর্ট বিশ্লেষণ করেই আমরা এই প্রতিবেদন তৈরি করেছি।”

কমিশনের সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার বলেন, “ঘটনার পেছনে মূল সমন্বয়কের ভূমিকায় ছিলেন শেখ ফজলে নূর তাপস। হত্যাকাণ্ডটি ছিল পুরোপুরি পরিকল্পিত। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা কৌশলে জড়িতদের রক্ষা করেছেন। এছাড়া প্রমাণ মিলেছে, শেখ হাসিনা নিজে সবুজ সংকেত দিয়েছিলেন।”

কমিশনের মতে, তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদকেও দায় এড়ানো যায় না। তার অধীনে থাকা সেনাবাহিনী কেন নিষ্ক্রিয় ছিল, তা এখনো রহস্যময়। রিপোর্টে এটিও বলা হয় যে, ঘটনার সময় পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোরও ছিল চরম ব্যর্থতা। এমনকি কিছু প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ভূমিকা ছিল “অপেশাদার ও সন্দেহজনক।”

আরও অভিযোগ করা হয়, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে যেসব বিডিআর সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছিল, তাদের নাম-পরিচয় সংরক্ষণ করা হয়নি। কমিশনের প্রতিবেদনে ভবিষ্যতের জন্য বেশ কিছু সুপারিশও রাখা হয়েছে, যাতে এমন হত্যাকাণ্ড পুনরাবৃত্তি না ঘটে এবং ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পান।

কমিশনের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. সাইদুর রহমান বীরপ্রতীক, সাবেক যুগ্মসচিব মুন্সী আলাউদ্দিন আল আজাদ, সাবেক ডিআইজি ড. এম আকবর আলী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. শরীফুল ইসলাম এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহনেওয়াজ খান চন্দন।

উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআরের সদর দপ্তর পিলখানায় বিদ্রোহী জওয়ানদের হাতে প্রাণ হারান ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা। ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও সে রিপোর্ট কখনো প্রকাশ পায়নি। তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ২০২৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর নিহত সেনা সদস্যদের স্বজনরা শেখ হাসিনা, মইন ইউ আহমেদসহ ৫৮ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিল করেন। এরপর ২৩ ডিসেম্বর সরকার নতুন করে তদন্ত কমিশন গঠন করে।

কমিশনকে দায়ীদের চিহ্নিত করা এবং দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের শনাক্ত করার সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব দেওয়া হয়। অবশেষে সেই তদন্তে উঠে এল রাষ্ট্র ও রাজনীতির অন্ধকারতম অধ্যায়ের বিস্ফোরক তথ্য।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *