সমালোচনা পিছু ছাড়ছে না জামায়াত নেতা শিশির মনিরের

‘আমি যদি জনাব তারেক রহমান সাহেবের জায়গায় থাকতাম; কোনো কিছু তোয়াক্কা না করে অনেক আগেই মায়ের কাছে চলে আসতাম’-এমন মন্তব্য করে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন সুনামগঞ্জ-২ আসনে জামায়াতের প্রার্থী ও সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী শিশির মনির। তাকে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন বিতর্ক তৈরি হয়েছে।

মা খালেদা জিয়ার গুরুতর অসুস্থতার মধ্যেও দেশে ফেরার বিষয়ে ‘সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ অবারিত ও একক নিয়ন্ত্রণাধীন নয়’—বলে ফেসবুক পোস্টে জানিয়েছেন তারেক রহমান নিজেই। এরপর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এখনই দেশে ফিরতে পারছেন কিনা—বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে জল্পনা-কল্পনা চলছে। 

৮১ বছর বয়সি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস, লিভার সিরোসিস, কিডনি জটিলতাসহ নানা শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছেন। গত ২৩ নভেম্বর শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে তাকে এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়।  বর্তমানে সেখানেই তিনি চিকিৎসাধীন আছেন। 

অসুস্থ মাকে দেখতে না আসায় সম্প্রতি তারেক রহমানকে উদ্দেশ করে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন আইনজীবী শিশির মনির। তিনি লেখেন, ‘আমি যদি জনাব তারেক রহমান সাহেবের জায়গায় থাকতাম; কোনো কিছু তোয়াক্কা না করে অনেক আগেই মায়ের কাছে চলে আসতাম’। তার এই মন্তব্যের পর নেটদুনিয়ায় সমালোচনার ঝড় উঠে। পরে সমালোচনার মুখে স্ট্যাটাসটি মুছে দেন শিশির মনির।

এর আগে বহুল আলোচিত বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের হত্যায় জড়িতদের পক্ষে আইনজীবী হিসেবে শিশির মনিরের নাম আসার পর সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে ব্যাপক সমালোচনা হয়।

এছাড়া পূজামণ্ডপে গিয়ে রোজা ও পূজাকে মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ মন্তব্য করেও তোপের মুখে পড়েন এই আইনজীবী। তার এই বক্তব্যের সমালোচনা করেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির শাহ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরীও। 

২০২৩ সালে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ১০ বছর ৪১ দিন দায়িত্ব পালনের পর বিদায় নেওয়ার পর আওয়ামী দোসর মো. আবদুল হামিদের প্রশংসা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন শিশির মনির। বিতর্কিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ডামি প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচিত এমপিকে শুভেচ্ছাও জানিয়েছিলেন এই জামায়াত নেতা। 

একের পর এক বিতর্কিত মন্তব্য ও কর্মকাণ্ডে সমালোচনা পিছু ছাড়ছে না জামায়াতের এই আইনজীবীর। সর্বশেষ তারেক রহমানকে নিয়ে মন্তব্য করে স্যোশাল মিডিয়ায় তোপের মুখে পড়েছেন শিশির মনির। 

শিশির মনিরের সমালোচনা করে জাপানে নির্বাসিত সাংবাদিক খোমেনী ইহসান বলেন, ‘শিশির মনির হাসিনার ১৫ বছর ফেসবুকে একটা সাহসী স্ট্যাটাস লেখেনি। জুলাই বিপ্লবের সময়টাতেও কিছু লেখেনি৷ কিন্তু ৫ আগস্টের পর বিশাল বিপ্লবী হয়ে গেছেন, তারেক রহমানের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করতে চায়। কিন্তু তার দৌঁড় শহীদ আবরার ফাহাদের খুনিদের আইনজীবী হয়ে পয়সা কামানো পর্যন্তই। এক সময় শিশির মনিরের সঙ্গে রাজনীতি করেছি এবং তার ভণ্ডামি ও কাপুরুষতা সম্পর্কে জানি৷ এরা এখন যতই পসরা জমিয়ে বসুক না কেন অবশ্যই কিছু মানুষ তাদের ঘৃণা করব’।

শিশির মনিরের কড়া সমালোচনা করে তিনি আরও বলেন, ‘শিশিরের বাপ-মা মার্কিন নাগরিক, তাদের কাছে তো যায়ই না, থাকে ঘর জামাই’।

তার সমালোচনা করে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রশিক্ষণ বিষয়ক সহ-সম্পাদক কামরুল ইসলাম বলেন, এক সময় আপনি কোর্টে সাবমিশন রাখলে সেকেন্ড রোতে বসে আপনার গলার আওয়াজ শোনা যেত না। আর এখন আপনার গলার আওয়াজে কোর্ট রুমে থাকা দায়। গত রিজিমের সময় আপনি প্রায়ই রাজনীতি থেকে দূরে থাকার কথা বলতেন, এই যে সাহস এখন দেখাচ্ছেন তা কোথায় ছিল? মওদূদী সাহেবের একটা ফতুয়া আপনারা মিস করে গেছেন, উনি গুপ্ত রাজনীতি হারাম বলেছিলেন। হারাম প্র্যাকটিস করে এখন বীর সাজা, এই সাজায় আপনারে খুবই বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে। আল্লাহ আপনাকে হেদায়েত দান করুন।

এক্স হ্যান্ডেলে রিভল্ট নামে একটি ভেরিফায়েড আইডিতে মন্তব্য করা হয়- ‘জনাব শিশির মনির, তারেক রহমানকে নিয়ে কথা বলার আগে নিজের অতীত দেখুন। তোমার তোয়াক্কা করা না করা যে কি ছিল, সেটি সবাই দেখেছে। এত বড়, বড় কথা বইলো না’।

সোসাইটি অব ব্রিটিশ বাংলাদেশি সলিসিটরস- এর প্রেস ও প্রচার সম্পাদক ফজলে ইলাহী বলেন, জামায়াতের এমপি প্রার্থী শিশির মনির ‘দুধে ধোয়া তুলসি পাতা’ নয়।

সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী গাজী কামরুল ইসলাম বলেন, আমি যদি শিশির মনির হতাম, নিজের পার্টিসহ অন্য পার্টি নিয়ে কথাই বলতাম না। কারণ বিগত ফ্যাসিস্ট আমলে তিনি ফ্যাসিস্টের বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি তিনি। 

অ্যাডভোকেট এমএইচ রায়হান বলেন, বিএনপির আইনজীবীরা যখন আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের অধিকার আদায় ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম করেন, শিশির মনির তখন আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার আসামিদের পক্ষে লড়াই করেন এবং তাদের খালাস করার প্রতিশ্রুতি দেন।সুতরাং শিশির মনিরের মুখে এই কথা মানায় না যে, উনি তারেক রহমানের জায়গায় থাকলে এখন এই অবস্থায় দেশে চলে আসতেন।  বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার বার বার তারেক রহমানের দেশে আসা না আসা নিয়ে ইমোশনাল হিট করার চেষ্টা করেছে আর এখন একটি দল ও গোষ্ঠীর কথা বার্তা শুনে এটি সুস্পষ্ট যে, তাদেরও ক্ষমতায় যাওয়ার প্রধান বাধা তারেক রহমান!

রাজ চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি ফেসবুকে লেখেন, শিশির মনির, আপনার মতো অযোগ্য, অদক্ষ ও অজ্ঞতায় ভরা মানুষ এই ভুবনে সত্যিই আসলেই বিরল। রোজা ও পূজাকে এক করে ফেলা, এটা আপনার ধর্মীয় অশিক্ষার পরিচয়। তারেক রহমানকে নিয়ে ঢালাও মন্তব্য আপনার রাজনৈতিক শিশুসুলভ মস্তিষ্কের সবচেয়ে স্পষ্ট প্রমাণ। আপনি জানেন না, একজন রাজনৈতিক নেতার দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত কোনো আবেগের ওপর চলে না। এটা চলে রাষ্ট্রশক্তি, বিচারহীনতা, নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক বাস্তবতার হিসেব-নিকেশে। এটা বোঝার মতো জ্ঞান, দূরদৃষ্টি বা তথ্য কোনোটাই আপনার মধ্যে নেই।

শিশির মনিরের সমালোচনা করে পাঠান সজিব বলেন, আরে ভাই, আপনি তারেক রহমানের জায়গায় কিভাবে থাকবেন? উনার জায়গায় থাকার মতো কোনো কাজ করেছেন? আপনি দেশপ্রেমিক আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার আসামি পক্ষের আইনজীবী ছিলেন। জুলাই আন্দোলনে আপনার ভূমিকা সম্বলিত একটা প্রমাণ দেখাতে পারবেন?

আজিজুল হক জিওন লেখেন, আমি শিশির মনির হলে দেশের পক্ষে কথা বলার জন্য জীবন দেওয়া বুয়েটের আবরার ফাহাদের হত্যাকারীদের পক্ষে আইনজীবী হিসেবে দাঁড়াতাম না! আমি শিশির মনির হলে পূজামণ্ডপ পরিদর্শনকালে ঈমান বিসর্জন দিয়ে রোজা এবং পূজাকে এক করে ফেলতাম না! 

আমি শিশির মনির হলে বাবা মায়ের খোঁজখবর না রেখে ঘরজামাই হিসেবে শ্বশুরের বাড়িতে থাকতাম না! 

শেখ হাসিনা এক সময় বলছিল মায়ের দুঃসময়ে কেন দেশে আসে না, তখন শেখ হাসিনার উদ্দেশ্য কী ছিল? 

ঠিক একই বয়ান দিল শিশির মনির। উনাদের উদ্দেশ্য কি তাহলে একই?

তিনি আরও বলেন, দুর্ভাগ্যজনক হলো ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে যিনি নিজেকে জাহির করছেন জাতির সামনে; ওই ব্যক্তি এখন তারেক রহমানকেও জ্ঞান দিতে আসে! অথচ ৫ আগস্ট পূর্ববর্তী সময় একদিনের জন্য হাসিনার ফ্যাসিস্ট আমল নিয়ে কোনো কথা বলেননি উনি।  মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি কখন হয়, এটা আমাদের নতুন করে বোঝার দরকার নেই।

হাসান এমএইচ বলেন, জুলাই আন্দোলনে শিশির মনিরের প্রকাশ্য কোনো ভূমিকা দেখাতে পারলে কান কেটে দেব। 

এর আগেও শিশির মনির নানা ইস্যুতে বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে ও অবস্থান নিয়ে বিতর্কিত হয়েছিলেন।  সূত্র : যুগান্তর

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *