কে এই ফয়সাল মাসুদ? আদাবরের ‘দাউদ’ নামে ছিলো যার পরিচয়

রাজধানীর বক্স কালভার্ট রোডে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী শরীফ ওসমান হাদি। হামলাকারী দুজনের পরিচয় শনাক্ত করলেও তাদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। হাদির ওপর গুলিবর্ষণকারী ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে রাহুলকে গ্রেপ্তার করতে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে সরকার। ইতিমধ্যে দেশব্যাপী সাঁড়াশি অভিযানের পাশাপাশি প্রত্যেকটি সীমান্তে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

পুলিশের সূত্র জানিয়েছে, হাদির ওপর গুলি চালানো এই ফয়সাল করিম মাসুদের গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার কেশবপুর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের কেশবপুর কলেজের পাশে। তার বাবার নাম হুমায়ুন কবির। বাউফলে বাড়ি হলেও প্রায় ৩৫ বছর আগেই তারা গ্রাম ছেড়ে রাজধানীর মোহাম্মদপুর আদাবর এলাকার বাসিন্দা হন। বর্তমানে আদাবর থানার পিস কালচার হাউজিং সোসাইটির ৯ নম্বর রোডের ৪১ নম্বর বাসায় ভাড়া থাকে।

২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে ‘আসনভিত্তিক সমন্বয়ক কমিটি’র সদস্য ছিল সে। এরপরই ২০১৯ সালে কার্যক্রম নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে নাম আসে তার। ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সহ-সভাপতির পদ পাওয়ার পর পুরো এলাকায় সে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। রিকশার গ্যারেজ থেকে জমি দখল, চাঁদাবাজি, অস্ত্রের মহড়া নিয়ন্ত্রণের জন্য তার আছে আলাদা বাহিনী। নিজের বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে অস্ত্র হাতে মহড়া ও অস্ত্র উঁচিয়ে এলাকায় প্রকাশ্যে গুলি ছোড়ার একাধিক ভিডিও মানবজমিনের হাতে এসেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন স্থানীয় ব্যক্তি মানবজমিনকে বলেন, দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আগে এমন কোনোদিন নেই যেদিন এই ফয়সাল করিম মাসুদ ও তার লোকজন এলাকায় তাণ্ডব চালায়নি। কিছু না হতেই তারা ধারালো অস্ত্র নিয়ে চলে আসতো। গুলি ছুড়তো। ৫ই আগস্টের পর সে ভোল পাল্টে আবার বর্তমানে এলাকার প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে। নবোদয় হাউজিংয়ে তাদের অফিসও রয়েছে। শুক্রবার যেদিন হাদিকে গুলি করা হয় সেদিন সকালেও ওই অফিসে যায় ফয়সাল। আর তার এসব কাণ্ডের সব সময়ের সঙ্গী আদাবরের স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা কবির ওরফে দাঁতভাঙ্গা কবির। হাদিকে গুলি করার আগে যাকে ‘হাদি কালচারাল সেন্টার’ অফিস রেকি করতে দেখা গেছে। ছাই রঙের জ্যাকেট, অফহোয়াইট রঙের প্যান্ট ও চামড়ার জুতা পরে ফয়সালের পেছন পেছন লিফট থেকে নামেন। আদাবর এলাকার নবোদয় হাউজিং, শ্যামলী হাউজিং ২য় প্রকল্প ও বেড়িবাঁধ এলাকার ছিনতাইকারী ও কিশোর গ্যাং লিডার হিসেবেও সে পরিচিত। এ ছাড়াও দাঁতভাঙ্গা কবির আদাবর এলাকার যুব মহিলা লীগের সভানেত্রী রোজি জয়িতার আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত। এই রোজি জয়িতাও একসময় জাহাঙ্গীর কবির নানকের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

কবির ছাড়াও আদাবর যুবলীগের রুবেল, আলমগীর, দীপু মোল্লা, আমিনসহ বেশ কয়েকজন সহযোগী রয়েছে ফয়সালের। হাদিকে গুলি করার সময় ওই আলমগীরই ফয়সালের সঙ্গে ছিল। সিসিটিভি ফুটেজ ও হাদির প্রচারণার বেশ কিছু ছবিতে ফয়সালের এসব সহযোগীদের দেখা গেছে। স্থানীয়রা বলেন, আদাবর এলাকার স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা কাওসার মোল্লার একান্ত ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন এই শুটার ফয়সাল। আর কাওসার মোল্লা আদাবর এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা ইয়াসিন মোল্লার ছেলে। যিনি জাহাঙ্গীর কবির নানকের একান্ত ঘনিষ্ঠ বলে সকলেই জানে। ৫ই আগস্টের পর ইয়াসিন মোল্লা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেলে এদের দেখভালের দায়িত্ব নেন নানকের এপিএস মাসুদুর রহমান বিপ্লব।

তিনি ভারত থেকে এই ফয়সাল গ্রুপের অর্থের জোগান দিতেন। ২০২৪ সালের ৭ই নভেম্বর আদাবরে বৃটিশ কলাম্বিয়া স্কুলের কার্যালয়ে ঢুকে অস্ত্রের মুখে ১৭ লাখ টাকা লুটের ঘটনায় ফয়সাল যখন দু’টি বিদেশি পিস্তল, দুটি ম্যাগাজিন, পাঁচটি গুলি, তিনটি মুঠোফোন ও পাঁচ হাজার টাকাসহ র‌্যাবের হাতে আটক হয় তখন এই বিপ্লবই বিপুল টাকার বিনিময়ে মাত্র ৩ মাসের মাথায় তাকে জামিনে জেল থেকে বের করে আনে। আদাবরের স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি- হাদিকে হত্যাচেষ্টার পুরো ঘটনার সঙ্গেই এই বিপ্লব জড়িত। তার ছত্রচ্ছায়াতেই রয়েছে ফয়সাল।

রাশেদা নামে আদাবর এলাকার এক রিকশার গ্যারেজের মালিক বলেন, আমি একজনের জায়গা ভাড়া নিয়ে একটি রিকশার গ্যারেজ করেছিলাম। কিন্তু একদিন হঠাৎ করে ফয়সাল ও তার দলবল এসে আমাকে বলে, ভাড়ার টাকা তাদের দিতে হবে। আমি তখন বলি, আপনাদের তো জায়গা না, যার জায়গা আমি তাদের ভাড়া দিবো। না হলে তো জায়গার মালিক আমার কাছে টাকা চাইবে। তখন ফয়সাল কোপ দিয়ে আমার গলা ফেলে দেয়ার হুমকি দেয়। আমি তাতেও রাজি না হওয়ায় রাতে অস্ত্রসহ দলবল নিয়ে চলে আসে। আমাকে মারধর করে। তখন বাধন নামে একটি ছেলে তাদের ঠেকাতে গেলে তাকেও মারধর করে। বন্দুক উঁচু করে গুলি করতে থাকে। তার কাছে সব সময় বন্দুক থাকে। ওই অস্ত্রের ভয়েই কেউ তাকে কিছু বলে না। আবির হোসেন নামে আদাবরের আরেক বাসিন্দা বলেন, ফয়সাল এতোটাই বেপরোয়া সে কারও কথা শুনতো না। দখলবাজি-চাঁদাবাজির টাকা দিয়েই সে চলতো। তার বাহিনীতে অনেক পোলাপান ছিল। যাদের বেশির ভাগ কিশোর গ্যাং, টোকাই। কিছু বলতে গেলেই ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলা করে। আর ফয়সালের কাছে থাকে দু’টি পিস্তল। সে নিজেকে আদাবরের ‘দাউদ’ বলে পরিচয় দিতো।

এদিকে মো. ইয়াসিন নামে মোহাম্মদপুর এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, পটপরিবর্তনের পর শুটার ফয়সাল নিজেকে একজন আইটি উদ্যোক্তা হিসেবে সকলের কাছে উপস্থাপন করে। তার লিংকডইন প্রোফাইল অনুযায়ী, সে ‘অ্যাপল সফট আইটি’, ‘ওয়াইসিইউ টেকনোলজি’ এবং ‘এনলিস্ট ওয়ার্ক’ নামক তিনটি প্রতিষ্ঠানের মালিক। তার প্রোফাইলে সে উল্লেখ করেছে, ২০১৩ সালে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞানে স্নাতক ও পরে এমবিএ সম্পন্ন করেছে । তার মালিকানাধীন ‘ওয়াইসিইউ টেকনোলজি’ই ২০১৬ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে ‘ব্যাটল অব ৭১’ নামে একটি কম্পিউটার গেম তৈরি করে। বেসিসের সহযোগিতায় তৈরি এ গেমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বেসিসের তৎকালীন সভাপতি মোস্তাফা জব্বার উপস্থিত ছিলেন। তার ওই আইটি প্রতিষ্ঠান ‘অ্যাপল সফট আইটি লিমিটেড’-এর সব ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি)।

শুটার ফয়সালের বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) এস এন মো. নজরুল ইসলাম বলেছেন, আমরা শুটার ফয়সালের পাসপোর্ট নাম্বারটা পেয়েছি। তার সর্বশেষ যে ট্রাভেল পাওয়া গেছে সেটা জুলাইয়ে সম্ভবত থাইল্যান্ড থেকে সে দেশে ইন করছে। এরপরে ইমিগ্রেশন ডাটাবেজে আর তার ডিপার্চারের কোনো তথ্য নেই। এরপরও ইমিগ্রেশনের বাইরেও যেহেতু ইন্ডিয়ার সঙ্গে আমাদের অনেকগুলো স্থল সীমান্ত আছে তাই বিজিবি সতর্ক আছে এবং আমাদের সকল ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে তার পাসপোর্ট নম্বর ব্লক করা আছে। আমরা এখনো মনে করি তারা দেশেই আছেন। সেভাবে আমাদের অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে এই ঘটনায় সন্দেহজন ৩ জনকে আমরা আটকও করেছি। হাদিকে গুলি করার ঘটনায় যেই মোটরসাইকেলটি ব্যবহৃত হয়েছে সেটাও আমরা উদ্ধার করেছি। আশা করছি, দ্রুত সময়ের মধ্যেই ফয়সালকে আটক করতে সক্ষম হবো। সূত্র : মানবজমিন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *