ময়মনসিংহের ভালুকায় ধর্ম নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ তুলে পোশাক কারখানার শ্রমিক দিপু চন্দ্র দাসকে (২৭) পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ তার পরিবারের। স্বজনরা জানান, নিহত দিপু তিন ভাইয়ের মধ্যে ছিলেন সবার বড়। মেজো ভাই জেলার তারাকান্দায় একটি ওয়ার্কশপে কাজ করেন, আর ছোট ভাই অষ্টম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। অভাব-অনটনের সংসারে পরিবারের হাল ধরতে ডিগ্রি পাস করে ২০১৮ সালে একটি কোম্পানিতে চাকরি নেন দিপু। বৃহস্পতিবার রাতে নিহতের পর ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল শুক্রবার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য দিপুর মরদেহ বাড়িতে নেওয়া হলে স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। বাড়িটিতে ভিড় করেন বহু পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজন।
ছেলের দগ্ধ মরদেহ দেখে মাটিতে বসে অঝোড়ে কাঁদতে থাকেন দিপুর বাবা রবি চন্দ্র দাস। তিনি আহাজারি করে বারবার বলতে থাকেন, ‘ছেলেকে মেরে রাস্তায় ফেলে রাখা হয়। আমার ছেলে এমন কোনো কাজ (ধর্ম অবমাননা) করতে পারে না। এর তদন্ত করে বিচার চাই, হত্যাকারীদের শাস্তি চাই।’
দিপুর স্ত্রী মেষলা রানী দাসের দাবি, তার স্বামীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। জানি না, আমার দুই বছরের মেয়েকে নিয়ে কীভাবে আমার সংসার চলবে। চোখে সব অন্ধকার দেখছি।’
নিহতের চাচাতো বোন চম্পা রানী দাস বলেন, নয়নপুর এলাকার একটি কারখানায় কাজ করেন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে তিনি উপস্থিত লোকজনের কাছে জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন, নবীকে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে দিপুকে হত্যা করা হয়েছে।
চম্পা রানী বলেন, ‘দিপু একজন শিক্ষিত মানুষ এবং সে এমন মন্তব্য করতে পারে না। দিপুকে অন্য কোনো কারণে হত্যা করা হয়েছে। তাকে বিবস্ত্র করে গাছে ঝুলিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে।’
ধর্ম নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে পোশাক কারখানার শ্রমিক দিপুকে হত্যার পর মরদেহ গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। বৃহস্পতিবার রাত ৯টার দিকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের জামিরদিয়া ডুবালিয়াপাড়া এলাকায় পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস (বিডি) লিমিটেড নামে একটি তৈরি পোশাক কারখানার সামনে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় কারখানাটির পাশের ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে আগুন জ্বালিয়ে একদল মানুষ বিক্ষোভ করেন। খবর পেয়ে পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা সেখান থেকে দগ্ধ লাশ উদ্ধার করেন। পরে মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে।
পিটিয়ে হত্যার পর লাশ আগুনে পোড়ানোর এ ঘটনায় জড়িতদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছে সরকার। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়। আর এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের শাস্তির দাবি জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। অন্যদিকে পিটিয়ে হত্যা করে গাছে ঝুলিয়ে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনার প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ ও মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি এবং বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ। একই সঙ্গে ঘটনার যথাযথ তদন্ত এবং দায়ীদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিও জানিয়েছে সংগঠন তিনটি। এ ছাড়া জড়িতদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ মাইনরিটি অ্যালায়েন্স।
ভালুকার ঘটনায় নিহত দিপু চন্দ্র দাস (২৭) ওই এলাকার পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস (বিডি) লিমিটেডের কারখানার শ্রমিক ছিলেন। তিনি তারাকান্দা উপজেলার বানিহালা ইউনিয়নের মোকামিয়াকান্দা গ্রামের রবি চন্দ্র দাসের ছেলে। এ ঘটনায় তার ভাই বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় ১৫০ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেছেন। দিপুকে হত্যা ও লাশ আগুনে পোড়ানোর ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
জানা গেছে, দিপু ওই কারখানায় লিংকিং সেকশনে কাজ করতেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার দিকে কারখানার ভেতরে এক শ্রমিক দিপুর বিরুদ্ধে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে কটূক্তির অভিযোগ করেন। ওই অভিযোগের কথা জানাজানি হলে স্থানীয় লোকজন ও কারখানার কর্মীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। পরে লোকজন কারখানার ফটক ভাঙার চেষ্টা করেন। তখন কারখানার নিরাপত্তাকর্মীরা দিপুকে বাইরে পাঠিয়ে দেন। তখন একদল বিক্ষুব্ধ মানুষের পিটুনিতে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় দিপুর। একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, রাত ৯টার দিকে দিপু কারখানার গেট দিয়ে বের হলে তাকে প্রথমে সেখানে মারধর করা হয়। পরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে নিয়ে গিয়ে একটি গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে ফের মারধর করা হয়। পরবর্তী সময়ে বিক্ষুব্ধরা মরদেহে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে মহাসড়কের উভয় পাশে যান চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায় এবং এলাকাজুড়ে চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। খবর পেয়ে পুলিশ ও সেনাসদস্যরা রাত পৌনে ১১টার দিকে লাশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যান।
পরে গতকাল ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে দিপুর মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গতকাল সকালে নিহত দিপুর ছোট ভাই তপু চন্দ্র দাস বাদী হয়ে ভালুকা মডেল থানায় লিখিত অভিযোগ দেন। পরে দুপুরে অজ্ঞাতপরিচয় ১৫০ জনকে আসামি করে ওই অভিযোগটি হত্যা মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়।
এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কারখানা কর্তৃপক্ষ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
ভালুকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ফিরোজ হোসেন জানান, লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এলাকার পরিস্থিতি বর্তমানে স্বাভাবিক আছে।
ময়মনসিংহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) মো. আবদুল্লাহ্ আল-মামুন কালবেলাকে বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত সব তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এ ঘটনায় যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
জড়িতদের ছাড় না দেওয়ার কথা জানাল সরকার: ময়মনসিংহে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে পিটিয়ে হত্যা করে আগুন দিয়ে পোড়ানোর ঘটনায় কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছে সরকার। গতকাল দুপুরে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, ‘ময়মনসিংহে এক হিন্দু ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় আমরা গভীরভাবে নিন্দা জানাই। নতুন বাংলাদেশে এ ধরনের সহিংসতার কোনো স্থান নেই। এই নৃশংস অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।’
সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের শাস্তি দাবি জামায়াতের: ভালুকায় পিটিয়ে হত্যা এবং পরবর্তী সময়ে লাশে আগুন দেওয়ার ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। একই সঙ্গে এমন ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের শাস্তির দাবি জানিয়েছে দলটি। জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার গতকাল এক বিবৃতিতে বলেন, ‘ইসলাম ধর্ম অবমাননা এবং আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী মানবতার বন্ধু হজরত মুহাম্মদকে (সা.) কটূক্তি করার অভিযোগে দিপু চন্দ্র দাস নামে এক হিন্দু যুবককে পিটিয়ে হত্যা এবং পরবর্তী সময়ে মৃত লাশে আগুন দেওয়ার ঘটনার নিন্দা জানাচ্ছি। এই হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই বাংলাদেশের প্রচলিত আইন দ্বারা সমর্থিত নয়। ইসলাম কখনো বিচারবহির্ভূত হত্যা, গণপিটুনি কিংবা সহিংসতার অনুমোদন দেয় না। অভিযোগ থাকলে তার নিষ্পত্তি আদালতের মাধ্যমেই হতে হবে—এটাই আইনের শাসনের মৌলিক নীতি।’
জড়িতদের শাস্তি দাবি পূজা পরিষদ, পূজা কমিটি ও ঐক্য পরিষদের: ধর্ম অবমাননার অভিযোগে পিটিয়ে হত্যা করে গাছে ঝুলিয়ে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ ও মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি এবং বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ। একই সঙ্গে ঘটনার যথাযথ তদন্ত এবং দায়ীদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিও জানিয়েছে সংগঠন তিনটি। গতকাল পূজা পরিষদ, পূজা কমিটি ও ঐক্য পরিষদের আলাদা আলাদা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ দাবি জানানো হয়।
পূজা পরিষদ ও পূজা কমিটির বিজ্ঞপ্তিতে এ ঘটনার যথাযথ তদন্ত এবং দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির দাবি জানানো হয়।
অন্যদিকে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘ভালুকায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগে এক গার্মেন্টস শ্রমিককে একদল দুর্বৃত্ত পিটিয়ে হত্যা করে লাশ গাছে ঝুলিয়ে আগুনে পুড়িয়ে সম্প্রীতি ক্ষুণ্নের উসকানি দিয়েছে। পরিষদ এহেন ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং অনতিবিলম্বে এ ঘটনার জন্য দায়ীদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছে।’
বাংলাদেশ মাইনরিটি অ্যালায়েন্সের নিন্দা: ধর্ম অবমাননার অভিযোগে পিটিয়ে হত্যা এবং হত্যার পর আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনার প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ মাইনরিটি অ্যালায়েন্স। একই সঙ্গে অবিলম্বে এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। গতকাল এক বিবৃতিতে সংগঠনটির মুখপাত্র প্রদীপ চন্দ্র দাস এ দাবি জানান।
বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘দিপু চন্দ্র দাস গার্মেন্টস কর্মী। সে সুপারভাইজার পদে পদোন্নতি পাওয়ায় তার প্রতিযোগী দুজন অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে তার বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার গুজব ছড়ায়। দিপুকে ডেকে নিয়ে ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ চিৎকার করে বলা হয়, তিনি ইসলাম ধর্ম ও নবীজীকে অবমাননা করেছেন। উপস্থিত উত্তেজিত জনতা অতীতের বহু ঘটনার মতো এবারও সত্য-মিথ্যা যাচাই না করেই তাকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে।’
প্রদীপ চন্দ্র দাস বলেন, ‘অতীতে দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্ম অবমাননার কথা বলে অসংখ্যবার মব সৃষ্টি করে হামলা ও হত্যার ঘটনা ঘটেছে। পরে দেখা গেছে, সেসব ঘটনায় ধর্ম অবমাননার কোনো ঘটনা ঘটেনি। এসব ঘটনার কোনো সুষ্ঠু বিচারও হয়নি। এতে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ওপর মব সৃষ্টি করে প্রায়ই হামলার ঘটনা ঘটছে।’ তিনি অবিলম্বে এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।
বিবৃতিতে জানানো হয়, ভালুকার এই ঘটনার প্রতিবাদে আজ শনিবার বিকেলে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করবে বাংলাদেশ মাইনরিটি অ্যালায়েন্স।
প্রতিবেদনটিতে তথ্য দিয়েছেন কালবেলা প্রতিবেদক, ঢাকা।


