সাত বছর পর নির্বাচন করতে ধানের শীষ চেয়েছিলেন তারা; না পেয়ে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করেই দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড়াতে জমা দিয়েছেন মনোনয়নপত্র। বিএনপির এমন নেতার সংখ্যা পৌনে দুইশর বেশি।
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে শতাধিক আসনে দলীয় মনোনয়নের বাইরে বিএনপির বিদ্রোহী হওয়ার পথে এখনও ভোটে রয়ে গেছেন এসব নেতা। লড়তে চান স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে।
তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন সাবেক সংসদ সদস্য যেমন আছেন, তেমনি জেলাসহ বিভিন্ন ইউনিটের নেতৃত্বাস্থানীয় নেতা রয়েছেন।
দলের কঠোর হুঁশিয়ারির মধ্যেও এদের বড় অংশ সোমবার তফসিলে বেঁধে দেওয়া সময় সীমার শেষ দিনে মনোনয়নপত্র জমা দেন।
ঢাকা বাদে ৬৩ জেলায় জমা পড়া মনোনয়নপত্রের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, ১১৮টি আসনে প্রায় ১৭৯ জন বিএনপি নেতা ধানের শীষ প্রতীকের মনোনীত প্রার্থীর বাইরে মনোনয়নপত্র দিয়েছেন।
দলের মনোনীত প্রার্থী বদল চেয়ে সমর্থক-অনুসারীদের বাদ-প্রতিবাদ আর বিক্ষোভ-আন্দোলনের মধ্যেই তারা ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে চান। তাদেরগুলোসহ এবার ৩০০ আসনে ভোটের ট্রেনে চড়তে মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে ২ হাজার ৫৮২টি।
এরমধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় ছয়টি আসনেই ধানের শীষের প্রার্থীর বাইরে বিএনপি নেতারা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন হলেন সাবেক সংসদ রুমিন ফারহানা।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের আমলে টকশোসহ বিভিন্ন মাধ্যমে সোচ্চার থেকে পরিচিতি পাওয়া এই বিএনপি নেত্রী দলের সিদ্ধান্তের বাইরে প্রার্থী হওয়া প্রসঙ্গে বলেন, “এ নির্বাচন জনগণের নির্বাচন। এ নির্বাচন ব্যক্তি রুমিন ফারহানার নির্বাচন। জনগণ এবার ভোটের মাধ্যমে সব কিছুর জবাব দেবে।
“আল্লাহর কী পরিকল্পনা, ধানের শীষের বিপক্ষে লড়াই করতে হচ্ছে!”
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ-বিজয়নগরের দুই ইউনিয়ন) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন তিনি।
রুমিন ফারহানার মত দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে বাগেরহাটের তিনটি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য এম এ এইচ সেলিম।
তিনি বলেন, এলাকার মানুষের ভালাবাসার টানেই দলের মনোনয়ন না পেয়েও নির্বাচন করতে চান তিনি।
“আমি বাকি জীবনটা মানুষের জন্য কিছু করে যেতেই স্বতন্ত্র পদে নির্বাচন করার অঙ্গীকার করেছি।”
এমন নেতাদের বিরুদ্ধে বিএনপি কঠোর অবস্থানে থাকবে বলে আগেই তুলে ধরেছিলেন জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
দলীয় ও শরিক জোটের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে প্রার্থীর বিরুদ্ধে ভোট করার বিষয়ে সোমবার রাতে দলের জ্যেষ্ঠ একজন নেতা বলেন, “দলের নীতি-নির্ধারণী ফোরামের সিদ্ধান্তে বিএনপি মহাসচিব এরই মধ্যে প্রার্থীর তালিকা প্রকাশ করেছেন। তারাই বিএনপির প্রার্থী।
“দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে কেউ প্রার্থী হয়ে থাকলে অবশ্যই দল এর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। তবে সেজন্য বাছাই শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।”
চব্বিশের আন্দোলনে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর এবার দেড় দশক ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগকে বাইরে রেখে ফেব্রুয়ারিতে হচ্ছে যাচ্ছে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন। দুই বছর আগের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি।
আর এর আগে ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলেও হেরে যায় বিএনপি, যে ভোটকে ‘রাতের ভোট’ বলে সেই থেকেই দাবি করে আসছে দলটি।
সেই ভোটের সাত বছর পর ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে বাইরে রেখে হতে যাওয়া এ নির্বাচনে অংশ নিতে যেকারণে বিএনপির অনেক নেতাদেরই আগ্রহ ছিল বেশি। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর নিজ আসনে গিয়ে নামেন প্রচারে।
তবে দলীয় টিকেট না পেয়ে ক্ষোভ-হতাশা থেকে দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ কর্মসূচির মাধ্যমে ভোটের মাঠে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যান তাদের অনেকেই। অনেকেই আবার দলের সিদ্ধান্ত মেনে সরে দাঁড়ান।
দুই দফায় সারাদেশে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণার পর থেকেই অনেক আসনে মনোনয়ন বঞ্চিত নেতা ও তাদের সমর্থকরা বিক্ষোভ, সড়ক ও রেলপথ অবরোধ, মশাল মিছিলসহ নানা কর্মসূচির পালন করেছেন। প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে কোথাও কোথাও সহিংসতার ঘটনাও ঘটেছে।
দেশজুড়ে ব্যাপক সংখ্যক নেতা প্রার্থী পরিবর্তনের আশায় মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন। তবে শেষ মুহূর্তে তাদের সবাই মনোনয়নপত্র জমা দেননি। যারা জমা দিয়েছেন, তাদের অনেকের প্রত্যাশা, এখনো সময় শেষ হয়ে যায়নি। দলীয়ভাবে হয়ত তাদের আসনে প্রার্থিতার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা হবে।
কোথায় বেশি বিএনপির স্বতন্ত্র
চব্বিশের অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের কার্যাক্রমে নিষেধাজ্ঞা থাকায় নিবন্ধনও স্থগিত হয়েছে, ফলে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির পর প্রথমবারের মত দেশের অন্যতম প্রাচীন এ দলকে ছাড়াই নির্বাচন হতে যাচ্ছে।
তাদের ১৪ দলীয় জোটের দুই শরিক জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টি ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে।
তবে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, জাতীয় পার্টিসহ ‘অধিকাংশ দল’ নির্বাচনে থাকায় এবং এখন পর্যন্ত ভোটের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ থাকায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন।
সোমবার মনোনয়নপত্র জমাদানের সময় শেষ হয়েছে। ৩০ ডিসেম্বর থেকে ৪ জানুয়ারি পর্যন্ত মনোনয়নপত্র বাছাই করা হবে। ৫ থেকে ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত মনোনয়নের ব্যাপারে আপিল করা যাবে এবং নির্বাচন কমিশন আপিল নিষ্পত্তি করবে ১০ থেকে ১৮ জানুয়ারির মধ্যে।
মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ সময় ২০ জানুয়ারি। এই সময়ের মধ্যে হয়ত অনেক বিএনপি নেতা নির্বাচনের মাঠ থেকে সরে দাঁড়াতে পারেন। এরপরই প্রকৃতপক্ষে জানা যাবে, বিএনপির কতটি আসনে কত প্রার্থী ‘বিদ্রোহী’ হিসেবে ভোটের লড়াইয়ের ময়দানে থাকছেন।
মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, নাটোর-১, ঝালকাঠি-১, কিশোরগঞ্জ-১, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ এর আসনে চারজন করে বিএনপি নেতাও ‘বিদ্রোহী’ হয়েছেন। তিনজন করে বিদ্রোহী আছেন আরও কিছু আসনে।
তবে শরীয়তপুর, মৌলভীবাজার, কক্সবাজার, লক্ষ্মীপুর, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, লালমনিরহাট, ভোলা, পিরোজপুর, নরসিংদীর মত জেলায় দলীয় নির্দেশ অমান্য করে কোনো বিএনপি নেতা প্রার্থী হননি।
আবার যশোরের ছয়টি আসনের মধ্যে একটিতে, খুলনার ছয়টি আসনের মধ্যে একটি, ফরিদপুরের চারটি আসনের মধ্যে একটিতে দলীয় প্রার্থীর বাইরে বিএনপি নেতা প্রার্থী হয়েছেন।
জোটকে ছেড়ে দেওয়া আসনেও বিএনপি নেতাদের প্রার্থী হতে দেখা গেছে। আবার বাগেরহাটে একজন বিএনপি নেতা তিনটি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন।
কী বলছেন তারা
মাদারীপুর-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর কামাল জামান মোল্লা বলেন, “আমাকে দল মনোনয়ন দিয়েছিল। কিন্তু পরে দল মনোনয়ন তুলে নিলেও শিবচরের সব নেতাকর্মী ও জনগণ আমার সঙ্গে রয়েছেন।
“আমি আশাবাদী, যদি নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ প্রশাসন নিশ্চিত করে তাহলে আমাকে শিবচরবাসী মনোনীত করবে।”
বাগেরহাট-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপি নেতা এম এ সালাম বলেন, “২০০৭ সালে বিএনপির দুর্দিনে দলের হাল ধরেছিলাম। ২০১৬ সাল পর্যন্ত দলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছি। আওয়ামী লীগের শাসনামলে নির্যাতন, হামলা, মামলার শিকার হয়েছি, জেল খেটেছি। দলের নানা কর্মসূচি পালন করেছি। নির্যাতিত নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছি।
“গত ১৬-১৭ বছর আমার দলে কী অবদান আছে তা সব নেতাকর্মী জানে। বিএনপির জরিপেও আমার অবস্থান সবার উপরে ছিল। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সব সময় বলে আসছেন দলের দুর্দিনে যারা ছিল দল তাদের মূল্যায়ন করা হবে। দল আমাকে কী দিল?”
তিনি বলেন, “সব পর্যায়ের নেতারা আজ হতাশ হয়েছে। দলের দুর্দিনে থাকা সেসব নেতাকর্মীরা আমাকে চাইছে। তাই তাদের চাপে আমি প্রার্থী হয়েছি। দলের মনোনয়ন পুর্নবিবেচনা করতে ভারপ্রাপ্ত চেয়াম্যানের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।”
বিকল্পের ব্যতিক্রমও আছে
এর বাইরে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তিনটি আসনে ‘বিকল্প প্রার্থী’ রাখা হয়েছে।
সুনামগঞ্জের পাঁচটি আসনেই বিএনপি দুজন করে প্রার্থীকে মনোনয়নের কথা জানিয়েছে। এসব আসনে বিএনপির দুজন নেতাই মনোনয়পত্র দাখিল করেছে।
এছাড়া চট্টগ্রাম-৬ আসনে গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী ও খন্দকার গোলাম আকবরকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়ার কথা জানানো হয়েছে। তারা দুজনই মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন।
নেত্রকোণা-৪ (মোহনগঞ্জ, মদন, খালিয়াজুরি) আসনে সাবেক প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের পাশাপাশি সেখানে তার স্ত্রী তাহমিনা জামান শ্রাবণীও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।


