মুনতাসির একজন ভালো হৃদয়ের মানুষ, যিনি আন্দোলনের সময় নিঃস্বার্থভাবে ছাত্রদের পাশে দাঁড়ান। তাকে শুধু একজন ‘গে অ্যাক্টিভিস্ট’ হিসেবে দেখার চাইতেও একজন মানবিক মানুষ হিসেবে দেখা উচিত। মানুষকে তার কাজ ও হৃদয়ের মানবিকতা দিয়েই মূল্যায়ন করা উচিত, পরিচয় দিয়ে নয়। আন্দোলনকালীন সময়ে মুনতাসিরের বিভিন্ন কর্মকান্ড তুলে ধরে, এমন বার্তায় যেন দিতে চেয়েছেন বুলুমবার্গের সাংবাদিক নাজমুল আহসান। মুনতাসিরকে নিয়ে নাজমুল আহসানের সেই পোষ্ট তাজাখবরের পাঠকদের তুলে ধরা হলো
হান্নান, মাহিন আর রিফাতের বহুল আলোচিত “সেইফ হাউজ” স্ক্যান্ডাল নিয়ে লিখতে গিয়ে অনেকটা তিক্ত স্বগতোক্তির মতো লিখেছিলাম: সাহায্য এসেছিল এক নাস্তিক, এক ভারতীয়, এক খ্রিস্টান কূটনীতিক, একজন অধিকারকর্মী যে কিনা গে আর ডেইলি স্টারের একজন সাংবাদিকের কাছ থেকে। এই কথাগুলো লিখেছিলাম আমাদের স্টেরেওটাইপ বা গৎবাঁধা চিন্তার প্রসেসকে চ্যালেঞ্জ করতে। বোঝাতে যে, কারও মানবতাবোধ একেবারে হিউমেইন একটা বিষয়; এই বিষয়টাকে তার গোত্র-পরিচয় দিয়ে মিলাইতে গেলে মিলবে না। কিন্তু যা হয় — সেই লেসনটা অনেকেই নেয় নাই; দুইয়ে দুইয়ে দশ মিলাইছে।
এক বন্ধুকে বলতে দেখলাম যে, এইটা নাকি ছিল একটা “আনহোলি অ্যালায়েন্স।” অর্থাৎ সেই পুরোনো গোপন ষড়যন্ত্র তত্ব। এগুলো মাথায় আসে তাদের যারা দুনিয়াটাকে ব্যাখ্যা করতে শিখেছেন বই আর ইন্টারনেটের আর্টিকেল পড়ে। আমার জীবনের ফরম্যাটিভ ইয়ার্সে আমিও অমন ছিলাম। মানুষকে মাপতাম তার বাহ্যিক পরিচয় দিয়ে এবং সেই বাহ্যিক পরিচয়ওয়ালা মানুষদের সম্পর্কে অন্যদের মুখে ও লেখায় যা পড়েছি, তা দিয়ে। কিন্তু যতোই বড় হয়েছি ততই এই ক্যারেক্টারগুলোকে নিজের চোখে দেখেছি; মিশেছি। অত্যন্ত মানবিক গুণাবলি, দোষগুণ কাছ থেকে দেখেছি। মানুষের মধ্যে কমপ্লেক্সিটি আছে, নুয়ান্সেস আছে, সেটা আমি অ্যাপ্রিশিয়েট করতে শিখেছি। ফলে আমি জীবনে অন্তত কিছুটা হলেও এই স্টেরিওটাইপিং করার হাত থেকে বেঁচে আসতে পেরেছি, অন্যদেরকে বেনেফিট অব ডাউট দিতে শিখেছি — আর সেজন্য আমি খোদা তাআলার কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।
এনিওয়েজ — ধান ভানতে শিবের গীত না গেয়ে কাজের কথায় আসি।
যাদের কথা আমি বলেছিলাম আগের স্ট্যাটাসে, তাদের সবাই সবাইকে চিনতো না। “অ্যালায়েন্স” তো দুর কা বাত। আমি এটাকে একাধিক চেইন বা মালার সঙ্গে তুলনা করেছি, যেখানে একজন লোক হয়তো তাঁর পাশের জনকে চেনেন, কিন্তু পরেরজনকে চেনেন না, নেসেসারিলি। এভাবেই সাধারণ নেটওয়ার্ক কাজ করে — লিঙ্কডইনের মতো: ফার্স্ট ডিগ্রি, সেকেন্ড ডিগ্রি, থার্ড ডিগ্রি কানেকশন।
ব্যাখ্যা করি।
সেই রাতের ঘটনায় যেই ডিপ্লোম্যাট আমাকে ফোন দিয়েছিলেন, তিনি কেন দিয়েছিলেন? পেশাগত কারণে আমার অনেক, অনেক ডিপ্লোম্যাটের সঙ্গে পরিচয়। কিন্তু কেউই তো আর যোগাযোগ করেনি। কেন তিনিই দিয়েছিলেন? আমাকেই বা কেন? আমি তো ঢাকাতেও থাকি না। এর উত্তর হলো: কারণ আমি তার পূর্ব-পরিচিত।
বাংলাদেশি সাংবাদিক ওভাবে সে আর কাউকে চেনে না; সেজন্য সুদূর ওয়াশিংটনে বসে থাকা আমাকে ফোন করেছেন। তিনি প্রচলিত অর্থে ডিপ্লোম্যাটও নন; অর্থাৎ তিনি ফরেইন সার্ভিস অফিসার নন; কন্ট্রাক্টে ছিলেন। ঢাকায় আসার আগে তিনি নিজ দেশে সম্পূর্ণ অন্য পেশায় ছিলেন। সেই পেশার সূত্র ধরেই ওনার সঙ্গে পরিচয়; পরে জীবনের বাঁকে তার পোস্ট পড়ে বাংলাদেশে — সেটা শুনে সেই পরিচয় আরও গাঢ় হয়। বাংলাদেশে তার কাজই ছিল সিভিল সোসাইটির সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, সেটাও অনেকটা কন্ট্রাকচুয়াল জব। অনেক দূতাবাসেই এমন কন্ট্রাকচুয়াল পজিশন থাকে অনেক।
আবার গড়পড়তা কূটনীতিক ছিলেন না বলেই হয়তো তিনি আর দশজন কূটনীতিকের মতো সতর্ক ছিলেন না। ঢাকাতে তো আরও শত শত অত্যন্ত ঝানু, এক্সপেরিয়েন্সড ডিপ্লোম্যাট থাকেন। কই কেউ তো আর গরজ দেখালো না। অনভিজ্ঞতার কারণেই হয়তো সরাসরিই এই মেসে জড়িয়েছেন আমার বন্ধু। আমাদের ফোনালাপে কতবার যে তার কান্নাকাটি আমাকে শুনতে হয়েছে! তার উপরওয়ালারা কীভাবে সব কোল্ড-হার্টেড ইয়ে, সেগুলো আমাকে যে কতবার শোনালো। তার আক্ষেপ, তার যন্ত্রণা, তার কষ্ট — এগুলো সরকারের থাকে না। থাকে মানুষের।
এবার এই বন্ধু-ডিপ্লোম্যাটের পরিচিত রাইটস অ্যাক্টিভিস্ট অর্থাৎ মুনতাসির রহমানকে আবার আমি চিনতাম না। সাদিক কায়েমের নাম্বারে ওই সেইফ হাউজের ঠিকানা দিয়ে আমার দায়িত্ব শেষ। ফলে ওই সময় আমি জানতামও না আর কে কে আগে বা পরে এতে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন।
মুনতাসিরের সংশ্লিষ্টতার খবর বা তার নাম আমি প্রথম জানতে পারি আগষ্ট পাঁচ তারিখের পরে। সাদিক কায়েম যখন শিবির সভাপতি হিসেবে সামনে আসলো, তখন যার মাধ্যমে মুনতাসিরের নাম আমি প্রথম জানতে পারি, তার মন্তব্য ছিল, মুনতাসির নিজেও হয়তো ছিলেন শিবির। অর্থাৎ সে নিজেও মুনতাসিরকে চিনতো না।
অনেক পরে — অর্থাৎ অতি সম্প্রতি আমি বাংলাদেশে গিয়ে ঘটনাচক্রে জানতে পারি, মুনতাসির একজন অ্যাক্টিভিস্ট। আরও জানতে পারলাম যে সাদিক কায়েমের সঙ্গে তার আদৌ কোনো সম্পর্কই ছিল না; শিবির হওয়া দূরে থাক। তার যোগাযোগ ছিল সরাসরি পালাতে থাকা ছাত্রদের সঙ্গে।
আবার বাংলাদেশে বিভিন্ন দূতাবাস বা আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে ভালো যোগাযোগ আছে এমন ব্যক্তিদের সংখ্যা অজস্র। কিন্তু এতকিছু থাকতে মুনতাসির কেন? কেন অন্য কেউ নয়? আর কারও কেন কোনো গরজ হয়নি ছাত্রদের দূতাবাসে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দেয়ার চেষ্টা করার?
এটার উত্তর জানতে হলে, আপনাকে পড়তে হবে ফারিয়া ভাষার স্ট্যাটাস (লিংক কমেন্টে দিলাম)। তিনি লিখেছিলেন যে, কীভাবে তার বুয়েটে পড়া ভাই রেহান আহসান শাপলা চত্বরে গিয়ে নিহত হয়েছিলেন; এবং সেদিন যেই লোকটা তার লাশ পর্যন্ত কাঁধে নিয়ে বহন করেছিলেন; হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন, তিনি হলেন মুনতাসির। মুনতাসির আর রেহান ছিলেন ক্লাসমেট। রেহানের তো আরও অনেক ক্লাসমেট ছিল; বন্ধু ছিল; কই কেউ তো আসে নাই? তাদের অনেক বন্ধু এখন বিরাট ইসলামি জোশে আছেন, তারাও আসে নাই। যেই হেফাজতের সমাবেশে গিয়ে রেহান নিহত হলো, সেই হেফাজত কিংবা বিএনপি-জামায়াতের কেউ এই ছেলেটার পরিবারের খোঁজ পর্যন্ত নেয় নাই।
তাহলে কীভাবে মুনতাসির এই খানে ঢুকল, সেটার উত্তর কি পেয়েছেন? যদি না পান, তাহলে স্পেল আউট করে বলি: কারণ মুনতাসির হলেন কাজের মানুষ, who shows up! সবার মনে এই দরদ থাকে না। অনেকে অনেক আল্লাহ-বিল্লাহ করতে পারেন, কিন্তু অপরের জন্য বিলিয়ে দেয়ার দিল থাকে না। আমার যেমন নাই।
সেদিন যেমন বন্ধুর লাশ কাঁধে নিতে মুনতাসির একজন দিলওয়ালা মানুষ হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, তেমনি ওইদিনও একজন মানুষ হিসেবে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাহিন, রিফাত, হান্নানদের সাহায্য করতে গিয়েছিলেন। গে অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে যান নাই।
মুনতাসিরের এই নতুন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত থাকার খবর আমি পাই তার স্ট্যাটাসে। দেখে আমি যারপরনাই বিস্মিত হয়েছি। বাংলাদেশকে তো তার চেনার কথা। এই দেশ তার পরিচয় মেনে নেবে, গ্রহণ করবে, এটা নিয়ে সে এতো আশাবাদী কী দেখে হইলো, তা ভেবে আমি কূল পেলাম না। কাকে যেনো মেসেজে বললামও, এটা নাইইভ হয়ে গেলো। What was he thinking! এরপরের ঘটনা তো জানাই। ২৪ ঘণ্টায় তার জীবন উলটপালট হয়ে গেছে। রাজনীতি তো দূরে থাক, এখন গর্দানটা আর ঠিকঠাক থাকে কিনা, সেটাই হলো প্রশ্ন।
আবার যেই ভারতীয়র কথা বলেছিলাম, যার দেয়া বাসায় প্রথম ছাত্রদের আশ্রয় জোটে, তার সঙ্গে আমার বন্ধু-কূটনীতিকের সম্পর্ক অনেক দূরবর্তী। তার কাজও মানবাধিকার ও সিভিল সোসাইটি নিয়ে; সেই সূত্রেই হালকা যোগাযোগ। তার সঙ্গে মুনতাসিরের আবার যোগাযোগ বা পরিচয় নাই।
তার সঙ্গে ছাত্রদের যোগাযোগ অন্য সূত্রে: এক স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠনের বরাতে ছাত্রদের মধ্যে সম্ভবত রিফাতের সঙ্গে তার প্রথম পরিচয় হয়। এই স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠনের চেয়ারম্যান আবার নরসিংদীর বিএনপির সঙ্গে জড়িত; আবার আনিসুল হক মেয়র থাকার সময় ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের আইনজীবী ছিলেন।
আবার যদিও তার ‘সেইফ হাউজে’র ঠিকানা আমার হাতে এসেছে আমার ডেইলি স্টার কন্ট্যাক্টের সূত্রে (আর বন্ধু ডিপ্লোম্যাটের সূত্রে), তবুও তার সঙ্গে এই ডেইলি স্টারের ভদ্রমহোদয়ার কোনো পরিচয়ইই ছিল না। ইন ফ্যাক্ট, আজ পর্যন্ত বোধ হয় তাদের সরাসরি কোনো যোগাযোগই হয়নি। কোনো এক ইন্টারমিডিয়ারির মাধ্যমে বাসার ঠিকানা আদানপ্রদান হয়েছে, যাকে আমি হয়তো চিনবোও না।
আমার সঙ্গেও তার কোনো যোগাযোগ ছিল না। নামে চিনতাম শুধু; কিন্তু কথা বা সরাসরি পরিচয় ছিল না। সবে এই সম্প্রতি আমি বাংলাদেশে যাওয়ার আগে খবর পেয়ে তিনি নিজ থেকে যোগাযোগ করে দেখা করতে চাইলেন। পরে দেখাও হলো এক আড্ডায়।
আবার যেই ব্যক্তিটি এই ছাত্রদের স্বশরীরে বিভিন্ন বাসায় নিয়ে গেলেন, তিনি একজন ইন্ডিপেন্ডেন্ট মানবাধিকার কর্মী, আমাদের রেজাউর রহমান লেলিন ভাই। লেলিন ভাই আর আমার খাতির বহুদিনের। অথচ, মজার বিষয় হলো, আমি জানতামই না লেলিন ভাই এই কাজে জড়িত ছিল। লেলিন ভাই আর আমার মাখামাখি অন্তত ডেইলি স্টারের কন্ট্যাক্ট কিংবা জুলকারনাইন সায়েরের আবির্ভাবেরও অনেক আগে। সম্ভবত ২০১৮-১৯ থেকে। ফলে সাহায্য চাওয়ার ক্ষেত্রে লেলিন ভাই হতে পারতেন আমার ন্যাচারাল চয়েস; কেন? কারণ উনিও কাজের মানুষ; He gets things done. অথচ, ওই তাড়াহুড়োয় আমার ওনার নামই মনে আসে নাই যে সাহায্য চাইবো; এর কারণ হলো, আমি আগে থেকেই ধরে নিয়েছিলাম যে ওনাদের উপর বাড়তি সারভেইলেন্স থাকবে। ফলে অবচেতন মনেই তার কথা আমি ভুলে যাই। অনেক পরে — আগস্ট ৫ তারিখেরও পরে আমি জানতে পারি যে, লেলিন ভাই এদের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। আবার লেলিন ভাই নিজেও জানতেন না এইটার সূত্রপাত আমারে দিয়ে — যখন তিনি জানলেন, আমরা কিছুক্ষণ হাসাহাসি করলাম; শেষ।
আমি এতো লম্বা ফিরিস্তি দিলাম এই জন্যে যে, এই খোদার দুনিয়ায় আল্লাহর ওয়াস্তে দৃষ্টিটা একটু বড় করেন। সন্দেহ পোষণ করা ভালো, সন্দেহবাতিক হওয়া ভালো না। মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে শেখেন। মানুষকে এজেন্সি দেন — মানুষ কারও ক্রিড়ানক পুতুল না। অন্তত জুলাইয়ে মানুষের মধ্যে যেই ডেসপারেশন ছিল, সেটা বিশুদ্ধ ছিল। কেউ জানতে চায় নাই কারও পরিচয়, কারও বর্ণ, কারও গায়ের রং, কারও ধর্ম: শুধু জানতে চেয়েছে, “পানি লাগবে? পানি?” এই স্পিরিটটা — অপরজনের বিপদে এগিয়ে আসা, অপরকে উদ্ধার করা, অপরের পাশে দাঁড়ানো — that was the best of us. ৫ তারিখ বেলা ২টায় মনে হয়েছিল না যে, আমরা এক অদ্ভুত ঐক্যবদ্ধ জাতি? ওই স্পিরিটের কারণেই সেই অনুভূতি জন্মেছিল। যেদিন থেকে আদারিং আর ক্রেডিটহোরিং করা শুরু হয়েছে, সেইদিনই ওই স্পিরিট ভাঙতে শুরু করেছে।