জুলাই অভ্যুত্থানে বিপ্লবী ছাত্র-জনতা চরম বর্বরতার শিকার হয়েছিল। ফ্যাসিবাদী সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর বুলেটের সামনে প্রতিরোধ গড়ে তুলে জীবন দিয়েছেন সহস্রাধিক মানুষ, আহত হয়েছেন ২২ হাজারেরও বেশি। শহীদ পরিবার ও আহতদের সহায়তায় সরকারি অর্থায়নে গড়ে তোলা হয় জুলাই শহীদ ফাউন্ডেশন (July Shaheed Foundation), যা শহীদদের পরিবারকে অর্থ সহায়তা এবং আহতদের চিকিৎসা ব্যয় বহন করে।
তবে, মানবিক সহায়তার এই প্রতিষ্ঠান থেকেও প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ইতিমধ্যে অন্তত ৫০ জন ভুয়া তথ্য দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলে জানা গেছে, যাদের শনাক্ত করে অর্থ ফেরতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রতারণার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় তিনজন গ্রেপ্তার হয়েছেন।
ভুয়া তথ্য দিয়ে অর্থ গ্রহণের কৌশল
ফটোশপ করে আহতের তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত
নয়ন শিকদার নামের এক ব্যক্তি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন শরীরে ইলেকট্রোলাইটের ঘাটতির কারণে। চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনেও তাই উল্লেখ ছিল। কিন্তু তিনি শরীরে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে, ফটোশপের মাধ্যমে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছেন এমন ছবি তৈরি করে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে আহতদের তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির আবেদন করেন জুলাই শহীদ ফাউন্ডেশনে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ‘ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস)’-এ তার তথ্য যাচাই হওয়ার পর, বিভ্রান্ত হয়ে সিভিল সার্জন অফিস তাকে প্রকৃত আহত হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। তবে ফাউন্ডেশনের ভেরিফিকেশন সেল তৎপর হয়ে প্রতারণার বিষয়টি উদ্ঘাটন করে।
ভুয়া দাবির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ
সড়ক দুর্ঘটনাকে আন্দোলনের আঘাত বলে দাবি
রাশেদুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি গত ৭ আগস্ট সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (পঙ্গু হাসপাতাল) (National Institute of Traumatology & Orthopaedic Rehabilitation)-এ ভর্তি হন। কিন্তু তিনি ফাউন্ডেশনের কাছে দাবি করেন যে, ৪ আগস্ট পাবনায় আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি আহত হন এবং এজন্য আহতদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থও গ্রহণ করেন।
পরবর্তীতে দ্বিতীয় দফার অর্থ পাওয়ার জন্য আবেদন করলে ফাউন্ডেশনের সন্দেহ হয়। তার মেডিকেল রিপোর্টে “আরটিএ” (রোড ট্রাফিক অ্যাক্সিডেন্ট) লেখা থাকায়, ফাউন্ডেশন বিষয়টি খতিয়ে দেখে। একপর্যায়ে রাশেদুল স্বীকার করেন যে, তিনি কোনো আন্দোলনে আহত হননি এবং টাকা ফেরত দেবেন বলে মুচলেকা দেন।
পারিবারিক ঝগড়াকে আন্দোলনের আঘাত বলে দাবি
রুনা আক্তার নামের এক নারী পারিবারিক ঝগড়ার কারণে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। পরে তিনি সেই চিকিৎসা সনদ দেখিয়ে আন্দোলনে আহত হিসেবে ফাউন্ডেশনের সহায়তা নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যাচাই-বাছাই শেষে তার আবেদন নাকচ করা হয়।
অটোরিকশা ছিনতাইয়ের ঘটনায় আহত ব্যক্তি আন্দোলনের আঘাত বলে সহায়তা নেন
বেলাল হোসেন নামের এক অটোরিকশাচালক পঙ্গু হাসপাতালে (NITOR) ভর্তি ছিলেন এবং তার একটি পা কেটে ফেলতে হয়। তিনি ‘ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস)’-এর তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করে আহতদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ গ্রহণ করেন।
কিন্তু তদন্তে জানা যায়, তিনি কোনো আন্দোলনে আহত হননি; বরং ৩০ ডিসেম্বর তার অটোরিকশা ছিনতাইয়ের সময় ছিনতাইকারীর গুলি ও ছুরিকাঘাতে আহত হন। যেহেতু তিনি একটি পা হারিয়েছেন এবং আর্থিকভাবে অসচ্ছল, মানবিক বিবেচনায় তার বিরুদ্ধে মামলা না করলেও, ফাউন্ডেশন তার কাছ থেকে টাকা ফেরত নেওয়ার জন্য মুচলেকা নেয়।
প্রতারক সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ
জুনায়েদ নামের এক প্রতারক আহতদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ভুয়া তথ্য দিয়ে তাদের নাম ‘ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস)’-এ অন্তর্ভুক্ত করতেন। তিনি আহতদের বলতেন, বরাদ্দকৃত অর্থ ইতোমধ্যে দেওয়া হয়ে গেছে, কিন্তু তিনি বিশেষ সংযোগের মাধ্যমে তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে পারবেন। বিনিময়ে, ফাউন্ডেশন থেকে প্রাপ্ত অর্থের অর্ধেক তাকে দিতে হবে।
এক আহত ব্যক্তির বাবা জুনায়েদকে ৩০ হাজার টাকা দিলে, বিষয়টি জানাজানি হয়। তাকে ফাউন্ডেশনের অফিসে ডেকে আনা হলে তিনি স্বীকার করেন, এরপর জুলাই শহীদ ফাউন্ডেশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা তার বিরুদ্ধে মামলা করলে তাকে জেলহাজতে পাঠানো হয়।
ফাউন্ডেশনের কঠোর ব্যবস্থা
জুলাই শহীদ ফাউন্ডেশনের (July Shaheed Foundation) ভেরিফিকেশন সেলের সমন্বয়ক সাইদুর রহমান শাহীদ বলেন,
“আমরা প্রকৃত আহতদের সেবা দিতে কাজ করছি। আহতদের নাম তালিকাভুক্তির জন্য আমরা মেডিকেল সার্টিফিকেট যাচাই করি এবং আহত ব্যক্তি কীভাবে ও কখন আহত হয়েছেন তা বিশদভাবে খতিয়ে দেখি। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেও তথ্য নিশ্চিত করি। কিছু প্রতারক আহত সেজে অর্থ নিতে চেয়েছিল, কিন্তু আমরা তাদের শনাক্ত করছি।”
ফাউন্ডেশনের লিগ্যাল অফিসার এডভোকেট পায়েল বলেন,
“আমরা ইতিমধ্যে কিছু ভুয়া আহতদের শনাক্ত করেছি। আমরা তাদের বিরুদ্ধে মামলা, অর্থ ফেরত চেয়ে শোকজ নোটিশ এবং মুচলেকা নেওয়ার ব্যবস্থা নিচ্ছি।”
ফাউন্ডেশন থেকে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ নেওয়ার অভিযোগে রাজধানীর রমনা থানায় দায়ের করা দুই মামলায় তিনজন বর্তমানে কারাগারে আছেন। প্রায় ৫০ জন প্রতারক মুচলেকা দিয়ে টাকা ফেরত দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। সময়মতো টাকা না দিলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আইনানুগ ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে
ফাউন্ডেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. জাহিদ হোসেন বলেন,
“জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন তিনটি উইংয়ে কাজ করছে। কেউ যদি ভুল তথ্য দিয়ে ফাউন্ডেশন থেকে অর্থ গ্রহণ করে, আমরা তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেব।”
প্রতারণা রোধে কঠোর নজরদারি
আহতদের জন্য নির্ধারিত সহায়তা প্রকৃত ভুক্তভোগীদের কাছেই পৌঁছাতে জুলাই শহীদ ফাউন্ডেশন কঠোর যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া অনুসরণ করছে। ভবিষ্যতে যেন কোনো প্রতারক এই সুযোগ নিতে না পারে, সে বিষয়ে আরও কঠোর নজরদারি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছে ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ।