বর্তমানে বাজারে কৃষিপণ্যের দাম উৎপাদন ব্যয়ের চেয়েও কমে যাওয়ায় কৃষকরা বিপাকে পড়েছেন। আলু, টমেটো ও পেঁয়াজের দাম হ্রাস পাওয়ায় কৃষকদের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
আলুর বাজার পরিস্থিতি
বাজারে প্রতি কেজি আলু ১৪-১৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যেখানে কৃষকদের উৎপাদন ব্যয় ১৩-১৪ টাকা। হিমাগারের ভাড়া আকস্মিকভাবে ৬০% বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকরা আলু সংরক্ষণ করতে পারছেন না, ফলে বাধ্য হয়ে মাঠেই কম দামে বিক্রি করছেন। মৌসুম শেষে আলুর দাম বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও সংরক্ষণের অভাবে কৃষকরা লোকসানের শিকার হচ্ছেন।
বগুড়ার পাইকারি বাজার মহাস্থানহাটে গত বছর জানুয়ারির মাঝামাঝিতে প্রতি মণ আলু ১১০০-১৩০০ টাকায় বিক্রি হলেও এবার তা ৪৫০-৬৫০ টাকায় নেমে এসেছে। রংপুরে প্রতি কেজি আলুর দাম গত বছর ২৫-৩০ টাকা থাকলেও বর্তমানে ৯-১০ টাকায় নেমে গেছে। জয়পুরহাটেও কৃষকরা আলুর কম দাম পেয়ে হতাশ।
টমেটো ও পেঁয়াজের বাজার পরিস্থিতি
প্রতি কেজি টমেটো উৎপাদনে কৃষকদের ব্যয় হয় ১২-১৩ টাকা, কিন্তু এটি ৮-১৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পেঁয়াজের উৎপাদন ব্যয় ৩৮-৪০ টাকা হলেও কোথাও কোথাও তা ৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ফলে কৃষকরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
চালের বাজার:
এদিকে চালের বাজারে দেখা যাচ্ছে সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র। বন্যার প্রভাব সত্ত্বেও আমন উৎপাদন ভালো হয়েছে এবং বিপুল পরিমাণ চাল আমদানি হয়েছে। তবে বাজারে চালের দাম রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে, বিশেষ করে সরু চালের কেজি ৮৫ টাকা পর্যন্ত উঠেছে।
মূল্যবৃদ্ধির পেছনে বড় মিলার ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সিন্ডিকেট দায়ী বলে অভিযোগ রয়েছে। তারা মৌসুমে ধান মজুত করে পরে সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়াচ্ছে। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, চালের সরবরাহ ঠিক থাকলেও অজানা কারণে দাম বেশি রাখা হচ্ছে। মিলাররা পাল্টা দাবি করছেন, খুচরা ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত মুনাফা করছে।
বাজার তদারকির অভাব ও মজুতবিরোধী অভিযানের অনুপস্থিতির কারণে সংকট আরও বেড়েছে। ঢাকাসহ উৎপাদন এলাকাগুলোতেও দাম বেশি। এ অবস্থায় সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি।
ভাড়া বৃদ্ধি ও এর প্রভাব
বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএসএ) গত ৮ ফেব্রুয়ারি হিমাগারে সংরক্ষণ ভাড়া ৬০% বাড়িয়ে কেজিপ্রতি ৮ টাকা নির্ধারণ করে, যা পরবর্তীতে আন্দোলনের ফলে কমিয়ে ৬.৭৫ টাকা করা হয়। কৃষি বিপণন আইন ২০১৮ অনুযায়ী, সরকারি অনুমোদন ছাড়া ভাড়া বৃদ্ধি করা যায় না, কিন্তু তা সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বৃদ্ধি করা হয়েছে।
সম্ভাব্য সমাধান
কৃষি অর্থনীতিবিদরা পরামর্শ দিয়েছেন:
১. হিমাগারে কৃষকদের জন্য ৩০% সংরক্ষিত জায়গার ব্যবস্থা করা।
২.কোল্ড স্টোরেজ ভাড়ায় কেজিপ্রতি ২ টাকা ভর্তুকি দেওয়া।
৩.সরকার নিজেই ৫-৭ লাখ কেজি আলু সংরক্ষণ করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
৪. আলু রপ্তানির উদ্যোগ গ্রহণ করা।
৫. কৃষকদের জন্য স্বল্প খরচে সংরক্ষণাগার নির্মাণে সহায়তা প্রদান।
সরকারের উদ্যোগ
কৃষি সচিব জানিয়েছেন, সরকার সারা দেশে ১০০টি মিনি কোল্ড স্টোরেজ তৈরি করছে এবং পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য ছোট সংরক্ষণাগার নির্মাণে কৃষকদের ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত সহায়তা দেবে। এছাড়া আলু রপ্তানির জন্য রপ্তানিকারকদের সহযোগিতার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
অতিরিক্ত উৎপাদন, হিমাগার ভাড়া বৃদ্ধি ও সংরক্ষণ সংকটের কারণে কৃষকরা বিপাকে পড়েছেন। যথাযথ সরকারি উদ্যোগ ও নীতিমালা প্রণয়ন করা না হলে কৃষকদের লোকসান আরও বাড়তে পারে, যা সামগ্রিক কৃষি অর্থনীতির উপর প্রভাব ফেলবে।