আল জাজিরার সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের (Zulkarnain Saer) এক বিশ্লেষণধর্মী পোস্টে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পটভূমি ও পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন।
সফল গণঅভ্যুত্থানের দুই মূল ভিত্তি
জুলকারনাইনের মতে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলন সফল হওয়ার পেছনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কাজ করেছে—সর্বস্তরের জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং সামরিক বাহিনী (Military Forces)–এর ন্যূনতম সমর্থন।
এছাড়াও, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিএনপি (BNP), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী (Bangladesh Jamaat-e-Islami), বাম ও ডান ঘরানার প্রায় সব রাজনৈতিক দল মাঠে থেকে এই আন্দোলনকে বেগবান করেছে।
ফ্যাসিবাদ পতনের পর গোপন চক্রের উত্থান
আওয়ামী লীগ (Awami League) সরকারের পতনের পর একটি পরিকল্পিত গোষ্ঠী দৃশ্যপটে আসে, যারা আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের কাঁধে বন্দুক রেখে তাদের লক্ষ্য হাসিলের জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠে।
এই গোষ্ঠী অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন স্তরে নিজেদের প্রতিনিধিদের বসাতে শুরু করে—মন্ত্রিসভা থেকে শুরু করে গোয়েন্দা সংস্থা (Intelligence Agency), এমনকি সামরিক কাঠামোতেও তারা হস্তক্ষেপ করে।
স্টেপ বাই স্টেপ ষড়যন্ত্রের ছক
স্টেপ ১: প্রচারযুদ্ধ এবং বিভ্রান্তিমূলক ন্যারেটিভ
এই গোষ্ঠী নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য প্রথমে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা শুরু করে। এদের ঘনিষ্ঠ এক সাংবাদিকের মাধ্যমে দেশে কোনো ইসলামি উগ্রবাদী সংগঠন নেই এমন এক প্রচার তৈরি করতে চায়, অথচ তারাই বিভিন্ন ধর্মীয় ইস্যু নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করে এবং সব দায় ছাত্র শিবির (Islami Chhatra Shibir) ও জামায়াতের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়।
স্টেপ ২: কিশোর গ্যাং ও চাঁদাবাজি
পরবর্তী ধাপে, দেশব্যাপী কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এবং বিএনপির ভেতরের একটি চিহ্নিত গ্রুপের সহায়তায় চাঁদাবাজির বিস্তার ঘটায়। এই গ্রুপটি দীর্ঘদিন ধরেই তারেক রহমান (Tarique Rahman)-কে বিএনপি থেকে মাইনাস করার চেষ্টায় লিপ্ত। পরিকল্পনা অনুযায়ী, চাঁদাবাজির জন্য দায়ী করা হয় বিএনপি এবং অপবাদে তারেক রহমানকে জড়িয়ে তাকে জনমানসে ‘ভিলেন’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালানো হয়।
স্টেপ ৩: সামরিক বাহিনীকে বিতর্কিত করা
এই গোষ্ঠী জানে যে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলে আগ্রহ নেই। তাই তারা নানা কৌশলে বাহিনীর নেতাদের বিতর্কিত করতে চায়, যাতে সেনাবাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি করে একটি সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়—যার রাজনৈতিক সুফল পাবে ওই চক্রটি।
ডিজিএফআই ও সাইবার ফোর্সের ভবিষ্যত
আওয়ামী লীগের শাসনামলে ডিজিএফআই (DGFI) এর অধীনে একটি বিশাল সাইবার ফোর্স তৈরি হয়েছিল যারা দলের পজিটিভ ইমেজ তৈরি, সামাজিক মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ এবং আইডি নিষ্ক্রিয় করতে ব্যবহৃত হতো। এই ফোর্স এখনো সক্রিয় এবং তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়া এক ‘বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা’র হাত ধরে নতুনভাবে মানসিক প্রভাব বিস্তারে ব্যবহার করা হচ্ছে।
তাদের টার্গেট—অর্থনৈতিক বা সামাজিকভাবে দুর্বল, ধর্মভীরু মানুষ। এদেরকে বেছে নিয়ে ধীরে ধীরে তাদের চিন্তাভাবনায় প্রভাব বিস্তার করা হয়, একইসঙ্গে সুন্দর পোশাক, জনপ্রিয় ভাষা, এবং ভালো চেহারা ব্যবহার করে জনমানসে প্রভাব তৈরি করে।
‘দ্য টার্নার ডায়রিজ’ এবং নৈরাজ্যের ব্লুপ্রিন্ট
জুলকারনাইন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ২০২১ সালের ক্যাপিটল হিলে হামলার পিছনের অন্যতম অনুপ্রেরণা ছিল ‘দ্য টার্নার ডায়রিজ’ নামক বইটি। এতে বিশ্লেষণ করা হয় কীভাবে সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে ক্ষমতা দখলের পথ তৈরি করা যায়। বাংলাদেশেও ছোটন এন্ড কোং এই কৌশল অনুসরণ করছে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি।
উপসংহার
সায়ের সতর্ক করে বলেন, আমরা যা দেখতে বা শুনতে চাই, সেটাই আমাদের দেখানো হয়। কিন্তু যখন আমাদের প্রত্যাশার সঙ্গে বাস্তবতা মেলে না, তখন আমরা ক্ষুব্ধ হই। কেন এমন হয়—এই প্রশ্নটি নিজেদেরকেই করতে হবে।