বাংলাদেশ যখন গণতন্ত্র পুনর্গঠনের মাধ্যমে নতুন ভবিষ্যৎ গড়ার চেষ্টা করছে, তখন দেশটিতে ইসলামি কট্টরপন্থার উত্থান লক্ষ করা যাচ্ছে। বিভিন্ন শহরে ধর্মীয় মৌলবাদীরা নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করছে, নারীদের খেলাধুলা থেকে বিরত রাখার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এবং ইসলাম অবমাননার অভিযোগে কঠোর শাস্তির দাবি তুলছে। “As Bangladesh Reinvents Itself, Islamist Hard-Liners See an Opening” শিরোনামে এক প্রতিবেদনে এমন দাবিই করেছে নিউইয়র্ক টাইমস। আর এদিকে ইসলামিস্টদের উত্থান নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনকে বিভ্রান্তিকর বলা হয়েছে প্রধান উপদেষ্টা প্রেস উইংয়ের পক্ষ থেকে।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানী ঢাকায় ইসলামি শাসনের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে বক্তারা সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, তাদের দাবি মানা না হলে নিজেরাই ব্যবস্থা নেবেন। এর পাশাপাশি, নতুন সংবিধান প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত রাজনৈতিক নেতারা স্বীকার করেছেন যে, বাংলাদেশে সেক্যুলারিজমের পরিবর্তে ধর্মীয় নীতিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে।
সমালোচকরা বলছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কট্টরপন্থী শক্তিকে প্রতিহত করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না, বরং তারা সংঘাত এড়াতে চাইছে। এর ফলে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে, যা মৌলবাদী দলগুলো নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগাচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নারীদের খেলাধুলার ওপর নিষেধাজ্ঞার ঘটনাগুলো বিশেষ উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। উত্তরবঙ্গের তারাগঞ্জে এক ফুটবল ম্যাচ আয়োজনের পরিকল্পনা কট্টরপন্থীদের চাপে বাতিল করা হয়। ইসলামি প্রচারকরা নারীদের খেলাধুলাকে ‘অশ্লীলতা’ আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ করতে চেয়েছে।
প্রতিবেদনটির দাবি, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মৌলবাদী উত্থানের ধারাবাহিকতা বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মতো বাংলাদেশেও ইসলামি শাসনের পক্ষে জনসমর্থন তৈরি হচ্ছে।
প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়, এদিকে, বৃহত্তম ইসলামপন্থী দল জামায়াতে ইসলামী বর্তমান রাজনৈতিক শূন্যতাকে একটি বড় সুযোগ হিসেবে দেখছে। দলটির নেতারা ইসলামি কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে এবং তুরস্কের মডেল অনুসরণ করতে চায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণের ফলে পুরোপুরি ধর্মীয় শাসন প্রতিষ্ঠা সহজ হবে না। তবে সেক্যুলারিজম দুর্বল হয়ে গেলে নারীদের অধিকার এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ভবিষ্যৎ ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ইসলামিস্টদের উত্থান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। তবে, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এটিকে বিভ্রান্তিকর ও একপেশে বলে উল্লেখ করেছে। মঙ্গলবার (০১ এপ্রিল) প্রকাশিত এক বিজ্ঞপ্তিতে প্রেস উইং জানায়, এই প্রতিবেদন বাংলাদেশ সম্পর্কে ভুল চিত্র তুলে ধরেছে এবং দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতাকে অতি সরলীকৃতভাবে উপস্থাপন করেছে।
প্রতিবেদনের বিভ্রান্তিকর দিক তুলে ধরেছে প্রেস উইং
প্রেস উইংয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, নিউইয়র্ক টাইমসের নিবন্ধটি এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের প্রকৃত উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে অবমূল্যায়ন করছে। তারা দাবি করে, এই প্রতিবেদন বাংলাদেশ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে এবং একটি সমগ্র জাতিকে অন্যায়ভাবে কলঙ্কিত করার ঝুঁকি তৈরি করে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ধর্মীয় উত্তেজনা এবং রক্ষণশীল আন্দোলনের কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা উল্লেখ করা হলেও, নিবন্ধে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির দিকটি উপেক্ষা করা হয়েছে। বিশেষ করে, নারীদের অবস্থার উন্নতি ও তাদের সুরক্ষায় সরকারের ভূমিকার বিষয়টি এতে উপস্থাপন করা হয়নি।
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ধর্মীয় সহিংসতা পৃথক বিষয়
প্রেস উইংয়ের মতে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতাকে ধর্মীয় সহিংসতার সাথে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। শেখ হাসিনার বিদায়ের পর সংঘটিত বিভিন্ন সংঘর্ষকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও প্রকৃতপক্ষে এগুলো রাজনৈতিক কারণে সংঘটিত হয়েছে।
বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করা হয়, রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়শই সমর্থন অর্জনের জন্য ধর্মকে ব্যবহার করে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। এই কারণে রাজনৈতিক অস্থিরতাকে ধর্মীয় নিপীড়নের সাথে মিশিয়ে দেওয়া বিভ্রান্তিকর এবং দেশের প্রকৃত রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে।
বাংলাদেশের অগ্রগতি ও প্রতিশ্রুতি
প্রেস উইং জানায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সন্ত্রাসবাদ দমন কার্যক্রমের মাধ্যমে সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কাজ করছে। তারা আরও জানায়, সামাজিক সংস্কার এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতার মাধ্যমে চরমপন্থা মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
বিবৃতিতে জোর দিয়ে বলা হয়, বাংলাদেশের বাস্তব চিত্র তুলে ধরার পরিবর্তে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো থেকে বিরত থাকা উচিত এবং দেশের সামগ্রিক অগ্রগতিকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।