মডেল মেঘনাকে আটকের দিনই ঢাকা ছাড়েন সৌদি রাষ্ট্রদূত ঈসা, প্রশ্নের মুখে কূটনৈতিক প্রভাব

মডেল ও মিস আর্থ বাংলাদেশ ২০২০ বিজয়ী মেঘনা আলম (Meghna Alam)–কে আটকের ঘটনাটি এখন ঘিরে রেখেছে রহস্য আর কূটনৈতিক চাপের গন্ধ। একই রাতে ঢাকা ছেড়ে গেছেন সৌদি রাষ্ট্রদূত ঈসা বিন ইউসুফ আল দুহাইলান (Isa bin Yousuf Al-Duhailan)। এমন সমাপতনকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উঠেছে একাধিক প্রশ্ন, মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, একজন বিদেশি রাষ্ট্রদূতের প্রভাবেই যেন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবস্থা নিয়েছে।

পুলিশ বলছে, মেঘনাকে নেওয়া হয়েছে ‘নিরাপত্তা হেফাজতে’, তবে বিশেষ ক্ষমতা আইনের আওতায় আদালতের নির্দেশে তাঁকে কাশিমপুর কারাগারে পাঠানো হয়েছে ৩০ দিনের জন্য। মূলত রাষ্ট্রদূতের একটি অনানুষ্ঠানিক অভিযোগের পরই পুলিশ ব্যবস্থা নেয়। অভিযোগ অনুযায়ী, মেঘনা রাষ্ট্রদূতের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা এবং হুমকির আশ্রয় নেন।

এ ঘটনায় মেঘনার এক সহযোগী সামিরকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার রেজাউল করিম মল্লিক (Rezaul Karim Mallick)। তবে পুলিশের এ দাবিকে মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেই দাবি করছেন মানবাধিকারকর্মীরা।

ঘটনার আগের রাতে ফেসবুক লাইভে এসে মেঘনা জানান, ‘পুলিশ পরিচয়ে’ কয়েকজন তাঁর বাসার দরজা ভেঙে ঢোকার চেষ্টা করছে। লাইভে তিনি স্পষ্ট করে বলেন, সৌদি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গেই তাঁর বিরোধ, এবং তাঁকে হুমকি দেওয়া হয়েছে যেন তিনি আর ফেসবুকে রাষ্ট্রদূতের নাম না নেন। পরদিন সকালে তাঁকে রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ডিএমপির পক্ষ থেকে জানানো হয়, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা, ভুয়া তথ্য ছড়ানো এবং আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কে অবনতি ঘটানোর মতো কার্যক্রমে জড়িত থাকার অভিযোগে মেঘনাকে আটক করা হয়েছে। তবে তাঁকে অপহরণ করা হয়নি বলেও দাবি করা হয়।

বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (Foreign Ministry) থেকে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে বলা হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুলিশকে তদন্তের নির্দেশ দেয়। পরে জানা যায়, রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে মেঘনার সম্পর্ক ছিল, এবং পুলিশ তাঁর পরিবারের মাধ্যমে বিষয়টি ‘সুরাহা’ করতে চেয়েছিল। তবে ব্যর্থ হয়ে তাঁকে আদালতের মাধ্যমে আটক দেখানো হয়।

রাষ্ট্রদূতের ঢাকাছাড়ার আগের দিন তিনি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এরপর রাতেই তিনি ঢাকার বাইরে চলে যান। এদিকে তাঁর ব্যবহৃত হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও সাড়া মেলেনি।

এই পুরো ঘটনার পেছনে বাংলাদেশ-সৌদি সম্পর্কের স্পর্শকাতরতা, প্রায় ২৫ লাখ প্রবাসী শ্রমিকের বিষয়টি, এবং রাষ্ট্রদূতের কূটনৈতিক অবস্থান বিবেচনায় নিয়ে পুলিশ ও প্রশাসন কৌশলী থেকেছে বলে জানায় একাধিক সূত্র।

অন্যদিকে, মানবাধিকার ও নারী অধিকারকর্মীদের অভিযোগ—মেঘনা আলমকে একটি ‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড’ কায়দায় তুলে নিয়ে গোপনে আটক করা হয়েছে। বিশেষ ক্ষমতা আইনের মতো বিতর্কিত আইনের প্রয়োগে একজন মডেলকে রাজনৈতিক কূটনীতির বলি বানানো হয়েছে বলেও মত দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা।

আইনের ব্যাখ্যায়, ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ৩ ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব বা আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডে যুক্ত ব্যক্তিকে বিচার ছাড়াই নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আটক রাখা যায়।

সব মিলিয়ে, মেঘনা আলমের আটকের মধ্য দিয়ে আবারও সামনে এলো বাংলাদেশে কূটনৈতিক প্রভাব ও মানবাধিকার রক্ষার টানাপোড়েন। সমাজে প্রশ্ন, একজন রাষ্ট্রদূতের ‘অভিযোগ’ কতটা ন্যায্যতায় রূপ নেয়—আর কতটা ‘প্রভাব’-এর বলে কাজ করে? সূত্র : আজকের পত্রিকা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *