ভারতের জন্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, যেখানে বিএনপি (BNP) দিনে দিনে হয়ে উঠেছে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। অতীতে যাদের নিয়ে দিল্লির মধ্যে ছিল সংশয়, সেই বিএনপিকেই এখন ভারত নতুনভাবে মূল্যায়ন করতে বাধ্য হচ্ছে। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর উদ্ভূত অস্থিরতা এবং আওয়ামী লীগের দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা দিনে দিনে দুর্বল হয়ে যাওয়ায়, ভারত আর আগের মতো ‘এক ঝুড়িতে সব ডিম রাখা’র কৌশল অনুসরণ করতে পারছে না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, ভারত বিএনপির সঙ্গে নতুন সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যা দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থ ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করতে বাধ্য হচ্ছে অনেকেই।
দিল্লির কূটনৈতিক অঙ্গনে এখন একপ্রকার অলিখিত স্বীকৃতিতে পরিণত হয়েছে যে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা অত্যন্ত শক্তিশালী। ভারতের নীতিনির্ধারকরা বুঝতে পারছেন, তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন, জনগণের মতপ্রকাশের অধিকার দমন এবং বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে কোণঠাসা করার ফলে আওয়ামী লীগ এখন নিজেই জনসম্পৃক্ততা হারিয়ে ফেলেছে। এই বাস্তবতায় ভারত কার্যত কোনো বিকল্প দেখছে না—চাইলেও এখন বিএনপির সঙ্গে কাজ করার পথ ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই।
একসময় ভারত যে বিএনপিকে ‘সমস্যাসংকুল’ হিসেবে বিবেচনা করত, সেই বিএনপিই এখন দিল্লির কূটনীতির কেন্দ্রে উঠে এসেছে। অতীতে হাসিনা সরকারবিরোধী আন্দোলনে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে বিএনপি ভারতের সহযোগিতা চেয়েও তা পায়নি। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় ভারত এখন বাধ্য হয়েছে বিএনপিকে মেনে নিতে এবং তাদের সঙ্গে ভবিষ্যতের কৌশল নির্ধারণ করতে। এতে করে স্পষ্ট হচ্ছে, বিএনপি এখন কেবল একটি বিকল্প নয়, বরং ভারতের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের একমাত্র সম্ভাব্য ও বিশ্বাসযোগ্য অংশীদার। বাংলাদেশে নিজেদের কৌশলগত স্বার্থ রক্ষায় ভারতের জন্য এখন বিএনপির সঙ্গে কাজ করাই একমাত্র বাস্তব পথ। ন্যূনতম সম্পর্ক বজায় রাখার প্রয়োজনেও দিল্লিকে বিএনপির সঙ্গেই আগাতে হবে।
তবে এটাও সত্য যে, বর্তমান ভারত (India) আগের সেই ‘বিএনপি-ভীতি’ ধারণা থেকে অনেকটাই সরে আস্তে বাধ্য হয়েছে। একদিকে ২০১৮ সাল থেকে বিএনপি আর জামায়াত-ই-ইসলামী (Jamaat-e-Islami)-র সঙ্গে কোনও জোট বা কার্যকর সম্পর্ক রাখছে না, অন্যদিকে ভারতের নিরাপত্তা সংক্রান্ত যেসব ‘ঐতিহাসিক আপত্তি’ ছিল, তাও আপেক্ষিকভাবে নরম হয়েছে।
‘অবশ্যই কথা হচ্ছিল, সবসময় বন্ধ ছিল না’
ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাই কমিশনার রিভা গাঙ্গুলি দাস স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, বিএনপির সঙ্গে কোনও যোগাযোগই ছিল না—এমনটা বলা ভুল হবে। তিনি বলেন, “সরকারে যারা থাকে তাদের সঙ্গেই স্বাভাবিকভাবেই কাজ হয়, কিন্তু এর মানে এই নয় যে অন্য দলগুলোর সঙ্গে আমাদের কোনও কথা হয়নি।”
এই বক্তব্য স্পষ্ট করছে যে, দিল্লি এখন এমন এক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে, যেখানে বিএনপির প্রতি ‘নিরাপত্তাজনিত সন্দেহ’ বা ‘প্রতিকূল মনোভাব’ পুরোটাই ছাপিয়ে গেছে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতায়।
ভারতের কাছে নতুন করে ‘গ্রহণযোগ্য’ বিএনপি
ভারতের জন্য দীর্ঘদিন বড় আপত্তির জায়গা ছিল বিএনপির জামায়াত ঘেঁষা অবস্থান এবং ২০০১-০৬ সময়কার শাসনামলে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বাংলাদেশে আশ্রয়। কিন্তু এখন আর সেই বাস্তবতা নেই। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক কার্যত শেষ। সেই সঙ্গে ভারতের অনেকে এটাও মনে করছেন, নতুন প্রজন্মের নেতা তারেক রহমান (Tarique Rahman) জামায়াত বিষয়ে অতীতের মতো অনমনীয় নন।
দিল্লির পর্যবেক্ষকদের মতে, ভারত এখন চায়—যে দলই ক্ষমতায় আসুক, তারা যেন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেয় এবং ভারতের সঙ্গে গঠনমূলক সম্পর্ক বজায় রাখে। বিজেপি নেতা শমীক ভট্টাচার্য বলেছেন, “বাংলাদেশে মৌলবাদ থেকে সরে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা জরুরি, হিন্দুরাও সুরক্ষিত থাকতে হবে।”
একসময় যা ছিল অসম্ভব, এখন তা ‘বাস্তব প্রয়োজন’
আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরে ভারতের একমাত্র রাজনৈতিক ভরসা ছিল। কিন্তু এখন সেই ভরসা ভেঙে পড়েছে। গত ৫ আগস্টের নাটকীয় পালাবদলের পর স্পষ্ট হয়ে গেছে—এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
ফলে ভারতের কূটনীতিকেরা বলছেন, বিএনপি যদি ভারতের কিছু মৌলিক নিরাপত্তাজনিত ‘উদ্বেগ’ যেমন সেভেন সিস্টারস অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয় না দেওয়া, চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যবহার চালু রাখা ইত্যাদি ঠিক রাখে, তাহলে দিল্লির পক্ষে বিএনপির সঙ্গে ‘ওয়ার্কিং রিলেশনশিপ’ গড়ে তোলা কঠিন নয়।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক শান্তনু মুখার্জি যেমন বলছেন, “যদি আমাদের উদ্বেগগুলো অ্যাড্রেস করে, তাহলে বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে কোনও সমস্যা নেই। আর যেহেতু তারা ক্ষমতায় আসছে—ভারতেরও বিকল্প নেই।”
ভারত এখন ‘নির্বাচনের পর’ সময়ের অপেক্ষায়
যদিও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রকাশ্যে কোনো পক্ষ নিচ্ছে না এবং নির্বাচনের আগে কোনো দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা প্রকাশ করা থেকেও বিরত আছে, কিন্তু পর্যবেক্ষকদের মতে, বাস্তবে দিল্লি এখন বিএনপিকে ভবিষ্যতের সরকারের অংশীদার হিসেবেই বিবেচনা করছে।
এ কারণেই বিএনপি নেতারা বিভিন্ন সময়ে বিজেপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গিয়েছেন, রাম মাধবদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন—যা একসময় ফলপ্রসূ হয়নি, কিন্তু এখন আবার সেসব চেষ্টার নতুন আবহ তৈরি হয়েছে।
শেষ পর্যন্ত ভারতের নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টিভঙ্গি হলো—“কে জিতবে সেটা বড় কথা নয়, জিতেই যদি নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক বাস্তবতা মানা হয়, তাহলে সেই দলের সঙ্গেই কাজ করতে হবে।” আর আজকের প্রেক্ষাপটে সেই দলটি যে বিএনপি—এটি এখন দিল্লির সবাই জানেন, মানেন, এমনকি মেনে নিতে বাধ্যও হয়েছেন।
পরিশেষে বলা যায়, ৫ই আগস্টের প্রেক্ষাপটে বর্তমান বাস্তবতায় বিএনপির আর ভারতের আশীর্বাদের প্রয়োজন নেই। বরং এখন ভারতেরই কৌশলগত স্বার্থ রক্ষায় বিএনপির সঙ্গে ন্যূনতম সম্পর্ক বজায় রাখা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে, আর সে কারণেই দেশটি নিজ থেকেই এই সম্পর্ক রক্ষায় আগ্রহী হয়ে উঠেছে ।
তথ্যসূত্র : বিবিসি বাংলা থেকে সংকলিত