রাষ্ট্র সংস্কারের আলোচনায় দুই প্রস্তাব নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে মতভেদ প্রকাশ করেছে বিএনপি (BNP)। একই ব্যক্তি যেন প্রধানমন্ত্রী, দলীয় প্রধান এবং সংসদ নেতা না হতে পারেন এবং কেউ যেন দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হন—এই দুটি বিষয়ে কমিশনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে দলটি।
রোববার জাতীয় সংসদের এলডি হলে সকাল ১১টায় শুরু হয়ে বিকাল ৫টা পর্যন্ত চলে বৈঠক। দ্বিতীয় দিনের আলোচনায় অংশ নেয় বিএনপির একটি পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধিদল। বৈঠক শেষে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ জানান, দুইবার টানা প্রধানমন্ত্রী হওয়া না গেলেও, এক মেয়াদ বিরতির পর আবার প্রধানমন্ত্রী হওয়া নিয়ে দলের আপত্তি নেই।
তিনি বলেন, “একই ব্যক্তি দলীয় প্রধান ও সরকার প্রধান হবেন না—এ ধরনের কোনো চর্চা আমরা আন্তর্জাতিকভাবে দেখি না। যুক্তরাজ্যেও পার্টি প্রধানই সরকার প্রধান। এটি গণতান্ত্রিক রীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।”
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সীমাবদ্ধ রেখে রাষ্ট্রপতিকে কিছু ক্ষমতা প্রদানের সুপারিশে বিএনপি সম্মত হলেও, প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় মেয়াদের সীমা বাধ্যতামূলক করার বিপক্ষে তারা। সংসদে উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ গঠনের ধারণায় দলটি একমত, তবে নির্বাচনী পদ্ধতি নিয়ে এখনও আলোচনা চলছে।
বিএনপি এনসিসি (জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল) গঠনের বিরোধিতা করে বলেছে, এটি হলে প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্র পরিচালনায় কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। দলটি সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে, যেখানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘বহুত্ববাদ’-এর উল্লেখ ছিল না। তবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে থাকা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাবে তারা একমত।
ইন্টারনেট প্রাপ্তি সংবিধানগত মৌলিক অধিকার হওয়া উচিত বলে মত দিয়েছে বিএনপি। তবে বাস্তবায়ন ক্ষমতার দিকে নজর রাখার পরামর্শ দিয়েছে তারা। সংসদ সদস্যদের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করতে অর্থবিল, আস্থা ভোট, সংবিধান সংশোধন ও জাতীয় নিরাপত্তা ব্যতীত অন্য বিষয়ে এমপিদের স্বাধীন মতপ্রকাশের সুযোগের সুপারিশ করেছে দলটি।
নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন ৫০ থেকে ১০০ করার প্রস্তাবে দলটি ইতিবাচক মত দিয়েছে। এছাড়া এমপি প্রার্থীর বয়স ২১ নির্ধারণে এখনো ঐকমত্য হয়নি।
স্থানীয় সরকারে স্বায়ত্তশাসন ও আর্থিক স্বাধীনতা নিয়ে বিএনপি নীতিগতভাবে একমত। তবে সংবিধানে না এনে এসব বিষয়ে আলাদা আইন প্রণয়নের পরামর্শ দিয়েছে দলটি। লোকাল গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট গঠনের প্রস্তাবেও বিএনপি নীতিগত সমর্থন দিয়েছে, তবে একইভাবে আইনের মাধ্যমে বাস্তবায়নের পক্ষে মত দিয়েছে তারা।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহারের বিরোধিতায়ও দলের অবস্থান স্পষ্ট। বিএনপি চায় এই নিষেধাজ্ঞা সংবিধানে যুক্ত হোক।
৭০ অনুচ্ছেদ প্রসঙ্গে দলটি বলেছে, এমপিদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে অর্থবিল, আস্থা ভোট, সংবিধান সংশোধনী এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যতীত বাকি সকল বিষয়ে স্বাধীনভাবে মত ও ভোট দেওয়ার অধিকার থাকা উচিত।
বিএনপির মতে, প্রজাতন্ত্র শব্দের অর্থ ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই। ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামটিই যথাযথ ও জনগণের মধ্যেই স্বীকৃত।
সংবিধানের মৌলিক নীতিসমূহ যেমন সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিয়ে কমিশনের সঙ্গে একমত হয়েছে দলটি।
আলোচনার শেষদিকে সালাহউদ্দিন আহমেদ জানান, সংবিধান সংস্কার প্রক্রিয়ায় বিএনপি আন্তরিকভাবে জড়িত। নির্বাচনী ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন এবং দুর্নীতিবিরোধী সংস্কার কমিশনসহ পাঁচটি কমিশনের প্রস্তাবনায় আলোচনা প্রায় শেষ পর্যায়ে।
বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। উপস্থিত ছিলেন সদস্য সফর রাজ হোসেন, বদিউল আলম মজুমদার ও ড. ইফতেখারুজ্জামান। বিএনপির পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন নজরুল ইসলাম খান, সালাহউদ্দিন আহমেদ, মো. ইসমাইল জবিউল্লাহ, রুহুল কুদ্দুস কাজল ও আবু মো. মনিরুজ্জামান খান।