মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের চলমান সংঘাতের প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক মহলের চাপের মুখে মানবিক করিডোর খোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। লক্ষ্য—যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে খাদ্য, ওষুধ ও জরুরি সহায়তা পৌঁছে দেওয়া। তবে এই উদ্যোগ বাংলাদেশের জন্য যেমন সম্ভাবনার দ্বার খুলতে পারে, তেমনি নতুন সংকটের আশঙ্কাও বাড়িয়ে তুলেছে, বিশেষজ্ঞরা এমনটাই মনে করছেন।
রাখাইনের মানবিক করিডোর কী?
মানবিক করিডোর হলো এক ধরনের নিরাপদ পথ, যেখানে সংঘাতের মাঝেও মানবিক সহায়তা পৌঁছানো সম্ভব হয়। রাখাইনে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও আরাকান আর্মি (Arakan Army) (AA)–র মধ্যে চলমান সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে এ রকম করিডোর চালুর প্রস্তাব এসেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও আঞ্চলিক শক্তিগুলো বিশেষ করে চীন (China) এবং আসিয়ান (ASEAN) দেশগুলোর মাধ্যমে এই করিডোর পরিচালনার আলোচনা চলছে। তবে করিডোরের নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, বিশেষত মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ও চীনের ভূমিকাকে ঘিরে।
বাংলাদেশের জন্য সম্ভাব্য সুফল
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মানবিক করিডোর চালু হলে রাখাইনে একটি তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হতে পারে। ফলে বাংলাদেশ (Bangladesh) দীর্ঘদিন ধরে যেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের চেষ্টা করছে, তার পথ কিছুটা প্রশস্ত হতে পারে। সীমান্ত অঞ্চলের নিরাপত্তা জোরদার হওয়ায় অর্থনৈতিক চাপও কিছুটা হ্রাস পাবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা নতুন মাত্রা পাবে।
সম্ভাব্য ঝুঁকি ও সংকট
তবে বিপদের ইঙ্গিতও স্পষ্ট। মানবিক করিডোরের আড়ালে যদি শুধু অস্থায়ী সহায়তা হয়, কিন্তু রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নাগরিক অধিকার নিশ্চিত না হয়, তাহলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আরও জটিল হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, রাখাইনে পরিস্থিতির অবনতি হলে নতুন করে শরণার্থী অনুপ্রবেশের আশঙ্কা রয়েছে। সেই সঙ্গে চীন এবং মিয়ানমারের জান্তা সরকার করিডোরের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করলে বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থানও দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।
আঞ্চলিক শক্তির তৎপরতা
রাখাইন ইস্যুতে চীন ও ভারত (India) নিজেদের স্বার্থে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। চীন তার চায়না-মিয়ানমার ইকোনমিক করিডর (China-Myanmar Economic Corridor) সচল রাখতে চায়, আর ভারত চায় তার কালাদান মাল্টিমোডাল প্রকল্প (Kaladan Multimodal Project) নিরাপদ রাখতে। আসিয়ান দেশগুলোও মানবিক সহায়তার নামে রাখাইনে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে আগ্রহী। বাংলাদেশের জন্য তাই অত্যন্ত সচেতন কূটনৈতিক কৌশল নেওয়া জরুরি হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের করণীয়
বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশকে এখনই জোরালোভাবে দাবি তুলতে হবে যাতে রাখাইনের মানবিক করিডোর জাতিসংঘ ও নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক সংস্থার অধীনে পরিচালিত হয়। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রাখতে হবে এবং একইসঙ্গে সীমান্ত নিরাপত্তা আরও জোরদার করা প্রয়োজন। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক কূটনীতিতে বাংলাদেশের সক্রিয় অংশগ্রহণই পারে এই সংকটের মাঝেও সুফল বয়ে আনতে।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া: বিএনপির উদ্বেগ
এদিকে মানবিক করিডোর নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর (Mirza Fakhrul Islam Alamgir)। সোমবার ঠাকুরগাঁওয়ে এক গণসংযোগ অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে এমন বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত ছিল সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করা।
মির্জা ফখরুল বলেন, “আজকে বাংলাদেশের বৈদেশিক উপদেষ্টা বলেছেন, রাখাইনে মানবিক প্যাসেজ দেওয়া হবে। এটা শুধু মানবিক সহায়তার বিষয় না, এর সঙ্গে আমাদের ভবিষ্যতের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার প্রশ্নও জড়িয়ে আছে।” তিনি তুলনা টেনে বলেন, “গাজায় যেমন মানবিক করিডোর বানিয়ে খাবার ও ওষুধ পাঠাতে হচ্ছে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও যদি এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়, তাহলে তা হবে উদ্বেগজনক।”
বিএনপি মহাসচিব আরও বলেন, “মানুষকে সাহায্য করা জরুরি, এতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে এ ধরনের বড় সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতভাবে হওয়া উচিত ছিল। আমরা চাই না বাংলাদেশ আরেকটি গাজার মতো সংকটে পড়ুক।”
উপসংহার
রাখাইনে মানবিক করিডোর খোলার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের সামনে একটি বড় সুযোগ এবং একইসঙ্গে বড় ধরনের ঝুঁকিও। সঠিক কূটনীতি এবং দূরদর্শী সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে, এই পথ বাংলাদেশকে উন্নয়নের দিকে নিয়ে যাবে, নাকি নতুন সংকটে ঠেলে দেবে।