তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম (Mahfuz Alam) সাম্প্রতিক সময়ে একটি সাহসী অবস্থান নিয়েছেন, যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে যখন নানা প্রচারণায় বলা হচ্ছিল, ‘‘ছাত্ররা ঘোর ডানপন্থী’’ এবং ‘‘আন্দোলনে পাকিস্তানপন্থী শক্তি কাজ করেছে’’, তখন মাহফুজ তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন—বাংলাদেশের রাজনীতিতে পাকিস্তানপন্থীদের কোনো জায়গা নেই। মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নেও কোনো আপোষ করা হবে না।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, জামাত-শিবিরকে একাত্তরের প্রশ্নে স্পষ্ট অবস্থান নিতে হবে। তার এই ঘোষণার পর প্রত্যাশিতভাবেই জামাত-শিবির, ডানপন্থী এবং পাকিস্তানপন্থী গোষ্ঠীগুলো প্রবল প্রতিক্রিয়া দেখায়। কেউ তাঁর বাবার মালিকানার কথা তুলে কটাক্ষ করেছে, কেউ আবার গরুর নামে মাহফুজের নামকরণ করে সেই গরু কুরবানির ঘোষণা দিয়েছে। অকথ্য গালিগালাজও করা হয়েছে।
তবে এই ঘটনাগুলো বরং স্পষ্ট করে দিয়েছে—কার অবস্থান কোথায়। স্বার্থে আঘাত লাগলে জামাত-শিবির ঠিক কতটা শক্তি প্রদর্শন করতে পারে এবং সীমালঙ্ঘন করে নিচে নামতে পারে তা যেমন প্রকাশ পেয়েছে, তেমনি মাহফুজের মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে আপসহীনতার চরিত্রটিও উন্মোচিত হয়েছে। দেশের সাধারণ মানুষও দেখতে পেয়েছে, মাহফুজ ও তাঁর সহযোদ্ধাদের অনেকেই জামাত-শিবিরের ধারার অংশ নন।
বিশ্লেষকদের মতে, এখন সময় এসেছে মাহফুজ, আসিফ, জাতীয় নাগরিক পার্টি (National Citizens’ Party – NCP) এবং ছাত্রদের নিজেদের আয়নায় দেখার। দেখার সময় হয়েছে, আন্দোলনের বিজয়ে অনেক সহযোদ্ধা হয়তো জামাতপন্থী ছিল, কিন্তু দিন শেষে তারা সেই ‘৭১’র পরাজিত শক্তিরই ধারক-বাহক। আবার জামাত-শিবিরের পক্ষেও আয়নায় নিজেদের দেখা জরুরি—যেখানে স্পষ্ট হবে, মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে কোনো ছাড় নেই।
আর যারা এতদিন ছাত্র আন্দোলন ও জামাত-শিবিরকে একসূত্রে গেঁথে দেখতে অভ্যস্ত ছিলেন, তারাও এবার বুঝতে বাধ্য হবেন—মাহফুজ, আসিফ এবং জামাত এক নয়। এক হয়ে যায়নি।
ভবিষ্যতের পথ ঠিক এখান থেকেই তৈরি হতে পারে। হয়তো মাহফুজ ও জামাত-শিবির আলাদা পথে হাঁটবে, অথবা একটা ‘কমনগ্রাউন্ড’ তৈরি করতে পারে, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনায় ঐক্য গড়ে উঠবে। প্রশ্ন থাকবে—এই ইনক্লুসিভিটি কতদূর বিস্তৃত হবে?
বর্তমানে এটা অসম্ভব মনে হলেও, ভবিষ্যতের বৃহত্তর স্বার্থে পতিত আওয়ামী লীগপন্থীদের কোনো অংশকেও (যারা মানবতাবিরোধী কর্ম থেকে বিরত থেকেছে তবে আওয়ামী সহানোভুতিশীল ) কি অন্তর্ভুক্তির আওতায় আনা সম্ভব হতে পারে? এ প্রশ্ন আজ গুরুত্বপূর্ণ। এতো বিশাল জনগোষ্ঠীকে উপেক্ষা করে কতদূর এগোনো যাবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।
এই ‘কমনগ্রাউন্ড’-ই হতে পারে বাংলাদেশের প্রকৃত প্রাণভোমরা। যেখানে টুপি পরা আর গেরুয়াধারী, বিজ্ঞানবাদী আর ধর্মবাদী, রবীন্দ্রভক্ত আর নজরুলপন্থী, হিজাবধারী আর টি-শার্ট পরা তরুণ—সবাই একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে নিজেদের ভাবনা ভাগ করে নেবে।
এই বাংলাদেশে কেউ কাউকে বাদ দেবে না, কেউ কাউকে মাথায় তুলবে না, বরং একে অন্যের মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করবে। এ দেশকে রক্ষার দায়িত্ব আমাদেরই; আমাদের ছাড়া কেউ এই দেশকে ভালোবাসবে না। আমাদের ছাড়া কেউ এই দেশের যত্ন নেবে না।
মাটির নিচে কোনো গুপ্তধনের দরকার নেই, কোনো তেলের খনিও নয়, দরকার শুধু এই মানবিক কমনগ্রাউন্ড—এই অনুভূতি।