মানবিক করিডোর ইস্যুকে সামনে রেখে সামরিক ও বেসামরিক কর্তৃপক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্বের খবর সম্প্রতি বিভিন্ন মাধ্যমে আলোচিত হলেও, আড়ালে চলছিল আরও গভীর ও স্পর্শকাতর সংঘাত। সেটি সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার এবং পিএসও ওয়ান জেনারেল কামরুলকে ঘিরে, যার সূত্রপাত হয়েছিল নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান (Khalilur Rahman)-এর নিয়োগের পর।
ঘটনাচক্রে, সামরিক বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ে একটি রদবদল এবং সেনাপ্রধানকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনার গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে, যেটিকে সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ (MI) পুরোপুরি অস্বীকার না করে বরং কিছু বেসামরিক বিশ্লেষক ও সাংবাদিকদের অবহিত থাকতে বলে। বলা হয়, মানবিক করিডোর ইস্যু এক ধরনের ‘সাইড শো’ মাত্র—আসল ঘটনা ঢাকতে ব্যবহৃত একটি পর্দা।
ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন জেনারেল কামরুল এবং তার সঙ্গে ড. খলিলুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। সামরিক সূত্রে জানা গেছে, এই সম্পর্ক অনেক সিনিয়র অফিসারের কাছে সন্দেহজনক ঠেকে এবং এতে আশঙ্কা তৈরি হয় যে, জেনারেল ওয়াকারের জায়গায় কাউকে বসানোর একটি রাজনৈতিক পরিকল্পনা এগোচ্ছে।
পরিস্থিতি তখন আরও নাটকীয় মোড় নেয়, যখন গুজব ছড়ায় যে সেনাপ্রধানকে সরিয়ে দেওয়ার একটি প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। একই দিন বিকেলে ইন্টারনেট প্রায় ৪০ মিনিটের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। সেদিন রাতেই ক্যান্টনমেন্টে কিছু ‘অস্বাভাবিক নাড়াচাড়া’ লক্ষ্য করা যায়, যার মধ্যে একাধিক ইউনিটকে সতর্ক থাকতে বলা হয়।
একজন সিনিয়র অর্থনীতিবিদের ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণে উঠে আসে, সেই রাতে ঢাকার রাস্তায় সেনাবাহিনীর যান চলাচল, কূটনৈতিক মহলে তৎপরতা এবং সরকারের মধ্যে একপ্রকার ঘাবড়ে যাওয়ার প্রবণতা।
এই পরিস্থিতিতে সেনাপ্রধান বিভিন্ন স্তরের কমান্ডারদের নিয়ে ধারাবাহিক বৈঠকে বসেন, এবং আর্মির অভ্যন্তরে ‘কু’ (coup) শব্দটি খোলাখুলি উচ্চারিত হতে শুরু করে। অনলাইন এক্টিভিস্ট পিনাকী , কনক সারওয়ার সহ একাধিক সামাজিকমাধ্যম বিশ্লেষককে এই নিয়ে বেশ উচ্ছাস প্রকাশ করতে দেখা গেলেও প্রথমে অনেকেই এই সম্ভবনার কথা উড়িয়ে দিয়েছিলেন।
বিশ্লেষকদের মতে, জেনারেল ওয়াকারের সাম্প্রতিক দরবারে দেওয়া বক্তব্য—যেখানে নির্বাচন এবং করিডোর ইস্যুতে তিনি প্রকাশ্যে মত দেন—তা কেবল একটি পলিসি স্টেটমেন্ট নয়, বরং তা সেনাবাহিনীর অবস্থান স্পষ্ট করার একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ, যা অনেকের চোখে ‘কু’ এরই সমতুল্য।
এই ঘটনার সরাসরি প্রতিক্রিয়ায়, বিশ্বস্ত সূত্র বলছে, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস (Muhammad Yunus) তার ঘনিষ্ঠ মহলে পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তবে, তাকে বোঝানো হয়, থামানো হয়—তবে পরিস্থিতির ভেতরের সঙ্কট তখনও বিদ্যমান।
ঘটনার নেপথ্যে ছিল মূলত একটি ব্যক্তিগত অথচ রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত স্পর্শকাতর দ্বন্দ্ব—নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান বনাম সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার। এই দ্বন্দ্ব রাজনৈতিক কাঠামোতে সামরিক হস্তক্ষেপের গন্ধ তৈরি করে, যা বাংলাদেশের দীর্ঘকাল ধরে চলমান বেসামরিক শাসন ব্যবস্থার জন্য একটি অশনিসংকেত।
আর্মি কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে ৯০-এর পর থেকে বরাবরই সরকারের প্রতি অনুগত থেকেছে। কিন্তু সেনাপ্রধানকে সরিয়ে দেওয়ার গুঞ্জন এবং সামরিক বাহিনীর প্রতিক্রিয়া এই লয়ালিটির ওপর এক বড় ধরনের চাপ তৈরি করেছে।
ইতিহাস থেকে দেখা যায়, পাকিস্তান ও মিশরে সেনাবাহিনী প্রধানদের সরানোর চেষ্টাই শেষ পর্যন্ত সামরিক অভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছিল। যদিও বাংলাদেশ এখনো সে পথে হাঁটেনি, তবে কিছু সাম্প্রতিক আলামত—বিশেষ করে সেনাবাহিনীর কড়া প্রতিক্রিয়া এবং মিডিয়ার নীরবতা—নতুন করে আশঙ্কার কারণ হয়ে উঠছে।
আমরা চাই না, বাংলাদেশ পাকিস্তান বা মিশরের পথ অনুসরণ করুক। চাই না, মিলিটারি ‘ছায়া সরকার’ হয়ে উঠুক। চাই, সেনাবাহিনী তাদের পেশাদার অবস্থানে থাকুক, এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বেসামরিক সরকারই নিক।
এই মুহূর্তে দেশবাসীর দায়িত্ব—গুজবে কান না দেওয়া, কিন্তু সত্য ঘটনাগুলোর দিকে চোখ খোলা রাখা। কারণ, ঘটনার সঠিক ব্যাখ্যা না বুঝলে, ভুল সিদ্ধান্ত এবং অস্থিরতা অনিবার্য হয়ে ওঠে।
-জিয়া হাসানের ফেসবুক পোস্ট থেকে সংকলিত