২০০৭ সালে সেনাবাহিনী অনিচ্ছাসত্ত্বেও ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিতে আহ্বান করেছিল। কিন্তু ইউনূস সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন, কারণ তিনি বুঝেছিলেন এই দায়িত্বের প্রকৃত রূপ—একজন ‘পাপেট’ বা নিয়ন্ত্রিত মুখপাত্র হয়ে থাকা। সেই সম্ভাবনাকে ঘৃণা করে তিনি গোটা দেশের নেতৃত্ব নেওয়ার সুযোগ ত্যাগ করেন। সেনাবাহিনীও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল, কারণ ইউনূস অন্ধ আনুগত্য প্রদর্শন করতেন না।
আজকের পরিস্থিতিও অনেকটা সেদিকেই ফিরে গেছে। ইউনূস এখনো নিজের স্বাধীনতাকে বিসর্জন দিতে রাজি নন। কেবল একটি ভয়ই তাকে আটকে রেখেছে—এই মুহূর্তে পদত্যাগ করলে দেশ আরও গভীর সংকটে নিমজ্জিত হতে পারে।
রাষ্ট্রযন্ত্রের অভ্যন্তরে এক ধরনের অধিকারবোধ দৃশ্যমান। বহু কর্মকর্তা মনে করেন, দেশের অগ্রগতির কৃতিত্ব শুধু তাদের। এই মানসিকতা বিশেষ করে সেনাবাহিনীতে আরও প্রবল। তারা বিশ্বাস করে, বাংলাদেশের পতন ঠেকিয়েছে তারাই—এবং বিনিময়ে তারা কৃতজ্ঞতাও পায়নি। এই মনোভাবই সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের প্রতি আজকের আনুগত্য ব্যাখ্যা করে, যদিও এক বছর আগেও তিনি বিদ্রোহের মুখোমুখি হয়েছিলেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সেনা মোতায়েনের পর মাঠের প্রতিক্রিয়া ছিল বৈরিতা ও অবিশ্বাস। জনগণের এই শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব সেনা সদস্যদের নিজেদের প্রধানের প্রতি সহানুভূতিশীল করে তোলে। তারা হয়তো প্রথমবারের মতো বুঝতে পারে, তিনি কী ধরনের জটিল অবস্থানে রয়েছেন।
তরুণ ছাত্রনেতারা এই সুযোগটি অনুধাবন করতে পারেনি। সেনাবাহিনীকে ক্রমাগত আক্রমণ করে তারা সেই সংহতিকে আরও দৃঢ় করেছে, যেটি ভাঙতে চেয়েছিল। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিও তাদের কৌশলগত ভুল হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। একটি ‘পরিশুদ্ধ আওয়ামী লীগ’ হয়তো তাদের দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা নিশ্চিত করত।
এই ভুলের প্রভাবে ড. ইউনূসও রাজনৈতিকভাবে চাপে পড়েন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের মতো সিদ্ধান্ত কোনো বড় দলের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া হবে না। সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা হয়নি, ইচ্ছাকৃতভাবে হোক বা পরিস্থিতির চাপে। বিএনপি এটিকে দেখেছে ইউনূসের দুর্বলতা হিসেবে—যেন তিনি কয়েক হাজার ছাত্রনেতার চাপের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন।
অন্যদিকে, সেনাবাহিনীর ভেতরেও তখন উত্তেজনা তুঙ্গে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন ডিজিএফআই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। পাশাপাশি একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে—সেনাপ্রধানকে সরিয়ে দেওয়া হতে পারে। যদিও কোনো মন্ত্রণালয় এ ধরনের প্রস্তাব দেওয়ার কথা অস্বীকার করে, তবুও স্পষ্ট হয়ে যায়, কেউ হয়তো উভয়পক্ষকেই খেলায় ব্যবহার করছে।
বিএনপি প্রায় দুই দশক ক্ষমতার বাইরে থেকে নানা ধরণের বিশ্বাসঘাতকতার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। নির্বাচন স্থগিত হওয়া নিয়ে সামান্য গুজবও দলটির মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করে। ইউনূস হয়তো এই ট্রমাকে গুরুত্ব দেননি, ফলে বিএনপি এখন সেনাপ্রধানের কথায় বেশি আস্থা রাখে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিশ্রুতির তুলনায়।
পরিস্থিতি আরও জটিল হয়, যখন বিএনপি এমনকি ইউনূসের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড পুনর্গঠনের মতো প্রশাসনিক সংস্কারকেও ‘জাতীয় নিরাপত্তা’ প্রশ্নে পরিণত করে। ইউনূস এটিকে এক ধরনের সীমালঙ্ঘন হিসেবে দেখেন।
আন্তর্জাতিক মিত্ররা পুরো সময়টাই সংযত ভূমিকা রেখেছে। তারা আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তকে পছন্দ না করলেও ইউনূসের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির কারণে নীরব ছিল। কিন্তু ধৈর্যের সেই সীমাও এখন ফুরিয়ে আসছে।
এই সংকটের পেছনে কোনো একক অপরাধী নেই—বরং পরস্পরের ভুলের চক্রবিন্যাস রয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কে নিজের অহং কিছুটা বিসর্জন দিয়ে এই জট খুলবে? এবং কেউ কি সাহস দেখাবে, সময় ও ধৈর্য শেষ হওয়ার আগেই?