সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে—কোন পথে ড. ইউনূস? : স্টেটসম্যানের সম্পাদকীয়

নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস (Dr. Muhammad Yunus) অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। একসময় যে উদ্যোগকে সাহসী গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের চেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছিল, এখন তা বিভক্তি, ক্ষোভ ও অনিশ্চয়তার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক The Statesman তার ‘Stalemate’ শিরোনামের এক সম্পাদকীয়তে বাংলাদেশের এই ক্রান্তিকালীন বাস্তবতা তুলে ধরে বলেছে, ড. ইউনূসের ‘সংস্কার আগে, নির্বাচন পরে’ নীতি মূল রাজনৈতিক প্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন। বড় রাজনৈতিক দলগুলো এই অন্তর্বর্তী সময়কে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের সুযোগ নয়, বরং ক্ষমতায় ফেরার স্ট্র্যাটেজিক খোলা দরজা হিসেবে দেখছে।

এই প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ছিল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী এবং দীর্ঘ সময় ক্ষমতাসীন দলটিকে হঠাৎ রাজনীতির বাইরে ঠেলে দেওয়া রাজনৈতিক ভূমিকম্পের মতো প্রভাব ফেলেছে। একদিকে এই নিষেধাজ্ঞা ছিল দীর্ঘমেয়াদি কর্তৃত্ববাদী আচরণের প্রতিকারে নেওয়া পদক্ষেপ, অন্যদিকে বিএনপির জন্য এটি হয়ে দাঁড়ায় একটি সুবর্ণ সুযোগ—একটি পরিষ্কার রাজনীতির মাঠ।

কিন্তু এই রাজনৈতিক সুবিধা এখন দ্রুত চাপে রূপ নিচ্ছে। বিএনপি ও তাদের সহযোগীরা এখন দ্রুত নির্বাচন চায়, দ্রুত সংস্কার নয়। তারা চায় ন্যূনতম পরিবর্তন, যাতে দ্রুত ক্ষমতায় ফেরা সম্ভব হয়। এই দাবি চাপ সৃষ্টি করছে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর, যেটি ইতোমধ্যে বিভক্তির শিকার।

বিশেষ করে উপদেষ্টা পরিষদের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এবং নবগঠিত ন্যাশনাল সিটিজেন্স পার্টি (এনসিপি) (National Citizens Party) এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা এই সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। আরও উদ্বেগের বিষয়, পাবলিক সার্ভিস সংশোধনী অধ্যাদেশ নিয়ে তৈরি হয়েছে তীব্র বিতর্ক, যার ফলে সিভিল সার্ভিসেও অসন্তোষ চরমে উঠেছে। এই উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে প্রশাসনের কার্যক্রম প্রায় অচল হওয়ার পথে।

জনগণের মধ্যে যে একসময়ে ড. ইউনূসের সংস্কার উদ্যোগের প্রতি আস্থা ও আশাবাদ ছিল, তা এখন অনিশ্চয়তায় রূপ নিচ্ছে। সময়সীমা বা দৃশ্যমান অগ্রগতি না থাকলে এই আশাবাদ সহজেই হতাশায় পরিণত হতে পারে। আর তখনই অন্তর্বর্তী ব্যবস্থার বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

সম্প্রতি সেনাবাহিনীর প্রভাব নিয়েও আলোচনা বাড়ছে। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান (General Waqar Uz Zaman) যে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের বার্তা দিয়েছেন, তা সামরিক প্রাতিষ্ঠানিক চাপের স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে। যদিও সেনাবাহিনীর ভূমিকা প্রকাশ্য নয়, কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই ‘নীরব প্রভাব’ বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ।

এই মুহূর্তে ড. ইউনূসের সামনে বাস্তবতা বড় কঠিন। একটি কেবল আদর্শনির্ভর পরিকল্পনা রাজনৈতিক বাস্তবতায় টেকেনা। গণতান্ত্রিক সংস্কার টিকে থাকে কেবল তখনই, যখন তার পেছনে থাকে সর্বদলীয় ঐকমত্য। আর তা না থাকলে এই উদ্যোগ বিচ্ছিন্ন এবং অকার্যকর হয়ে পড়বে। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।

এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ হয়তো একটাই—রাজনৈতিক সমঝোতা। হয় ড. ইউনূস নির্বাচনকে অগ্রাধিকার দিয়ে বাস্তববাদী পথে হাঁটবেন, নয়তো এই পুরো অন্তর্বর্তী কাঠামো ভেঙে পড়ার ঝুঁকিতে পড়বে। বাংলাদেশ এমন এক মোড়ে দাঁড়িয়ে যেখানে আদর্শ নয়, বাস্তবতাই মূল চালিকাশাশক্তি হতে চলেছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *