দীর্ঘ আত্মগোপনের পর মুখ খুললেন ওবায়দুল কাদের, ‘আমি এখনও সাধারণ সম্পাদক’

প্রায় সাড়ে নয় মাস চুপ থাকার পর, রাজনৈতিক নাটকের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা ওবায়দুল কাদের অবশেষে মুখ খুলেছেন। কলকাতায় অবস্থানরত এই সাবেক মন্ত্রী সম্প্রতি বিবিসি বাংলার (BBC Bangla) এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, তিনি এখনও কার্যত নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের (Awami League) সাধারণ সম্পাদক। তার ভাষ্যমতে, গত বছরের গণ-আন্দোলনের সময় তিনি দেশব্যাপী ধাওয়া-পালানোর মধ্য দিয়ে বেঁচে যান এবং শেষে নভেম্বর মাসে দেশ ছাড়েন।

আত্মগোপনের বিবরণ দিতে গিয়ে ওবায়দুল কাদের জানান, পাঁচই আগস্ট আন্দোলনের চূড়ান্ত দিনে তিনি সংসদ ভবন এলাকায় নিজের বাসায় ছিলেন। মিছিল শহরের দিকে এগোতে থাকলে তিনি অন্য একটি বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন। সেখানেও আন্দোলনকারীরা হানা দিলে তিনি স্ত্রীসহ বাথরুমে আশ্রয় নেন।

কাদেরের দাবি, “আমি বাথরুমে ঢুকে গিয়েছিলাম। ওখানে অনেকক্ষণ ছিলাম। আন্দোলনকারীরা পুরো ঘর ভাঙচুর করছিল, তবে আমার স্ত্রী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে অসুস্থ বলে বোঝানোর চেষ্টা করেন।” শেষ পর্যন্ত, আন্দোলনকারীদের মধ্যকার একাংশের সহানুভূতির কারণে তিনি প্রাণে বেঁচে যান বলে জানান।

তার মতে, কিছু আন্দোলনকারী প্রথমে তাকে জনতার হাতে তুলে দিতে চাইলেও অন্যরা তাকে বাঁচিয়ে দেন। তারা কাদেরের পোশাক পরিবর্তন ও মুখে মাস্ক পরিয়ে তাকে এবং তার স্ত্রীকে ইজিবাইকে করে জনতার ভিড় থেকে সরিয়ে নেন।

তবে এরপর তিনি কোথায় ছিলেন, কার আশ্রয়ে ছিলেন কিংবা কিভাবে দেশ ছাড়লেন, সে সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানাননি। কেবল এটুকু বলেন, “তিন মাস পরে, নভেম্বর মাসে আমি দেশ ছেড়েছি।”

দলের নেত্রী শেখ হাসিনা বা অন্য কারও সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না রেখেই আত্মগোপনে ছিলেন বলে দাবি করেছেন কাদের। তিনি বলেন, “আমার একটা কনসার্ন ছিল। আমাকে ধরার জন্য অভিযান চলছিল। তাই বাসা বদলাতে হয়েছে বারবার।”

আন্দোলন দমনে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে প্রশ্নে তিনি দায় দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সরকারের নির্দেশে কাজ করেছে বলে দাবি করেন তিনি। দলীয়ভাবে কেবল সদস্যদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছিল বলে জানান কাদের।

আন্দোলনে প্রাণহানির বিষয়টি নিয়ে অনুশোচনার প্রশ্নে কাদের বলেন, “ভুল হয়ে থাকলে দেশের মাটিতে ক্ষমা চাইতে পিছপা হবো না। কিন্তু দেশের বাইরে থেকে ক্ষমা চাইবো কীভাবে?” তার দাবি, দলের অভ্যন্তরে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে।

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, কাদেরের বক্তব্যে এখনো সেই পুরনো ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ই জিইয়ে রাখা হয়েছে, যার আশ্রয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ তাদের পতনের কারণ ব্যাখ্যা করে যাচ্ছে। দেশে ফেরা, ক্ষমা প্রার্থনা বা নতুন রাজনীতির প্রশ্নে এখনো অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে।

গত বছর পাঁচই আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিনে শেখ হাসিনা (Sheikh Hasina) দেশ ছেড়ে ভারতে পাড়ি জমান। দলের অনেক নেতা দেশ ত্যাগ করেন কিংবা গ্রেপ্তার হন। তবে ওবায়দুল কাদের কোথায় ছিলেন, তা ঘিরে রহস্য থেকেই গিয়েছিল। এখন তিনি জানালেন, ক্যান্টনমেন্টে তিনি আশ্রয় নেননি, বরং ব্যক্তিগত বাসায় গা ঢাকা দিয়েছিলেন।

শেষ পর্যন্ত তিনি জানালেন, “আমি এখন কলকাতায় আছি, এবং আমি দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবেই কথা বলছি। আমাদের কাউন্সিল হয় তিন বছর পর পর, ডিসেম্বর পর্যন্ত আমার মেয়াদ আছে।”

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দাবি অনুযায়ী, গত বছরের গণআন্দোলনে প্রায় ১৪০০ মানুষ নিহত হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মতে, এই সংখ্যা অন্তত ৮৩৪ জন। এসব ঘটনাকে ঘিরে এখন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ অনেক নেতার বিচার চলছে। দলটির কার্যক্রমও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।

এমন প্রেক্ষাপটে, ওবায়দুল কাদেরের হঠাৎ প্রকাশ্যে আসা আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ রাজনীতি ঘিরে নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তিনি এখনো নেতৃত্বে থাকার দাবি করলেও, বাস্তবে দলটি আদৌ ফিরে আসতে পারবে কিনা—এ নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *