যুক্তরাজ্য সফররত বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস (Dr. Muhammad Yunus)-কে ঘিরে আয়োজন করা ‘মতবিনিময় ও নাগরিক সংবর্ধনা’ অনুষ্ঠানটি নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে বাতিল করা হলেও, বাস্তবচিত্র যেন আরও জটিল। প্রবাসী বাংলাদেশিদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার এই আয়োজন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ক্ষোভে ফুঁসছে ব্রিটিশ বাংলাদেশি কমিউনিটি।
লন্ডনে অবস্থানরত বাংলাদেশ হাইকমিশনের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রধান উপদেষ্টার আগমন উপলক্ষে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছিল। হাইকমিশনার আবিদা ইসলাম (Abida Islam) বলেন, ‘হারমনি অ্যাওয়ার্ড ২০২৫’ পুরস্কার প্রাপ্তি দুই দেশের বন্ধন দৃঢ় করবে।
তবে ১২ জুন নির্ধারিত মতবিনিময় ও নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটি আকস্মিকভাবে বাতিল হওয়ার ঘটনায় প্রবাসীদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে অসন্তোষ ও সংশয়। অনুষ্ঠান বাতিলের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে “নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি”, কিন্তু যুক্তরাজ্যের মতো নিরাপদ দেশে এমন যুক্তি কতটা গ্রহণযোগ্য—সেই প্রশ্নই ঘুরছে কমিউনিটির মধ্যমাঠে।
পেছনের গল্প: পরিকল্পনা, প্রস্তাব এবং প্রতিবন্ধকতা
সূত্র জানায়, সফরের পরিকল্পনার শুরুতেই লন্ডনে প্রবাসীদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভা ও নাগরিক সংবর্ধনার সিদ্ধান্ত হয়। এই আয়োজনের সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় লন্ডন প্রবাসী শাহগির বখত ফারুক (Shahgir Bakht Faruk)-কে, যাঁকে ড. ইউনূস ব্যক্তিগতভাবে এই দায়িত্ব পালনের জন্য নির্বাচিত করেন।
ফারুক যুক্তরাজ্যের ব্যবসায়ী ও সামাজিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে কাজ করে ১২ জুন ‘দ্য গিল্ডহল, সিটি অব লন্ডন’-এ অনুষ্ঠান আয়োজনে অগ্রসর হন। তবে ৬ জুন তিনি টেক্সট মেসেজে কমিউনিটির নেতৃবৃন্দকে জানিয়ে দেন—অনুষ্ঠানটি ‘নিরাপত্তা ও সুরক্ষার’ কারণে বাতিল করা হয়েছে।
নিরাপত্তা নাকি রাজনৈতিক চাপ?
তবে ঘটনার গভীরে গেলে ভিন্ন চিত্র উঠে আসে। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ এবং কিছু প্রভাবশালী কমিউনিটি সংগঠনের আপত্তির মুখে অনুষ্ঠান ভেস্তে যায়। গিল্ডহল কর্তৃপক্ষকে শতাধিক ইমেইল পাঠিয়ে অনুষ্ঠান আয়োজনের বিরোধিতা করা হয়—যেখানে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়, ড. ইউনূসকে নিয়ে হলে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে পারে। ফলে হল কর্তৃপক্ষ অনুষ্ঠান বাতিল করে দেয়।
এমনকি বিকল্প হিসেবে অন্য হল বুক করার চেষ্টা করলেও একই রকম বাধার মুখে পড়ে আয়োজকরা। শেষ পর্যন্ত, নিরাপত্তার অজুহাতে অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ বাতিল করে দেওয়া হয়—যা কার্যত রাজনৈতিক বিরোধিতার ফল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
কে এই শাহগির বখত ফারুক?
সুনামগঞ্জের ঐতিহাসিক বখত পরিবারের সন্তান শাহগির বখত ফারুক যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে সক্রিয় হলেও বাংলাদেশের দলে-রাজনীতিতে জড়িত নন। তিনি একসময় কনজারভেটিভ পার্টি থেকে এমপি পদে নির্বাচন করেন এবং বর্তমানে ব্রিটিশ বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স-এর উপদেষ্টা।
তাঁর পরিবার আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ হলেও নিজে মূলত ব্রিটিশ রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক পরিমণ্ডলে সক্রিয়। ব্যক্তিগতভাবে ড. ইউনূসের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বলেও একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
ইউনূসের সফর এবং উচ্চপর্যায়ের আলোচনা
প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সফরের মূল উদ্দেশ্য যুক্তরাজ্যের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করা। সফরকালে তাঁর রাজার সঙ্গে বৈঠক এবং বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচারের বিষয়েও আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। সফরসঙ্গী হিসেবে থাকছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর (Dr. Ahsan H. Mansur) এবং দুদক চেয়ারম্যান ড. আবদুল মোমেন (Dr. Abdul Momen)।
তবে লন্ডনের রাজনীতি ও কমিউনিটি বিভাজনের বাস্তবতা যেন এবার ড. ইউনূসের নাগরিক সংবর্ধনার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।